Image description

কুমিল্লা মুরাদনগরের ধর্ষণের ঘটনায় মূল আসামি ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. নাজির আহমদ খাঁন।

২৬ জুন রাতে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে বাহেরচর পাঁচকিত্তা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী নারী মুরাদনগর থানায় অভিযুক্ত ফজর আলীকে (৩৮) আসামি করে ধর্ষণ মামলা করেছিল।

আজ এ ঘটনায় দুটি মামলা হচ্ছে। ধর্ষণের অভিযোগে ফজর আলীর বিরুদ্ধে একটি। ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধে পর্নোগ্রাফি ও নারী শিশু দমন আইনে আরেকটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগীর সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রেমের সম্পর্ক ছিল ফজর আলীর। ওই নারী স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন ১৫ দিন আগে। ঘটনার রাতে পাশের বাড়িতে পূজা চলছিল। বাড়িতে একা ছিলেন ওই নারী। এই সুযোগেই ফজর আলী কৌশলে তার বাড়িতে প্রবেশ করে।

একটি সূত্র জানায়, ফজর আলীকে ধরার জন্য একটি চক্র ওঁত পেতে ছিল বাড়ির পাশে। রাতে যখন ফজর আলী ভুক্তভোগীর বাড়িতে প্রবেশ করে, তার কিছুক্ষণ পরেই স্থানীয় কয়েকজন যুবক দরজা ভেঙে ওই নারীর ঘরে প্রবেশ করে। পরে তাদের মারধর এবং ভিডিও চিত্র ধারণ করে ।

৫৭ সেকেন্ড এবং এক মিনিট ১০ সেকেন্ডের দুটি ভিডিওতে দেখা যায়, জোর করে ভিডিও করছে স্থানীয় কয়েকজন যুবক। এ সময় ভুক্তভোগী নারী কাপড় পরার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভিডিও ধারণকারী যুবকরা কাপড় পরায় বাধা দেয়। একদিকে ভিডিও করতে থাকে, অন্যদিকে তারা ফজর আলীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়।

তারপর ফজর আলী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিল। গত শুক্রবার ওই নারী মুরাদনগর থানায় গিয়ে ফজর আলীকে একমাত্র আসামি করে ধর্ষণের মামলা করেন।

ওই নারীর মা জানান, টাকা লেনদেনের বিষয়ে ফজর আলী তার বাড়িতে আসা-যাওয়া করতো। কিন্তু ফজর আলীর ভাই এই আসা যাওয়া পছন্দ করতো না।

তিনি আরো বলেন, ঘটনার রাতে ঘরে এসে দেখি আমার মেয়ে ও ফজর আলীকে মারধর করছে স্থানীয় যুবকরা। আমার ওপরও হামলা করে তারা। এলাকার যুবকরাই দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করেছে বলে জানান ভুক্তভোগীর মা।‌

তিনি আরো জানান, তার মেয়ের জামাই বিদেশ থেকে বলেছেন কোনো মামলা না করার জন্য। মান ইজ্জত যা যাওয়ার গিয়েছে। যেহেতু জামাই আমার মেয়েকে নিয়ে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছে, এ জন্য মামলা তুলে নেয়ার চিন্তা করছি। জামাই বলেছে আপনার মেয়ে আপনি কীভাবে বাঁচাবেন এই চিন্তা করেন।

মামলা উঠানোর বিষয়ে কেউ চাপ দিচ্ছে কিনা এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর মা বলেন, না, আমাকে কেউ চাপ দিচ্ছে না। আমরা দেশের শান্তি চাই। এজন্যই মামলা উঠিয়ে নিতে চাই। আমার জামাই বলেছে মেয়েকে নেবে। তখন মামলা দিয়ে আমি কি করবো।

প্রসঙ্গত, শনিবার সন্ধ্যায় ধর্ষণের ৫৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় সারা দেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। টনক নড়ে প্রশাসনের।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফজর আলীকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বানিয়ে অপপ্রচার শুরু করে একটি চক্র।

জানা যায়, ফজর আলী ৫ আগস্টের আগে রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া খোকনের বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে কাজ করতো। তার আওয়ামী লীগের মিছিলে থাকা কয়েকটি ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দলীয় রূপ পরিবর্তনের পাঁয়তারা শুরু করে ফজর আলী। স্থানীয় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড বিএনপি নেতাদের সাথে শুরু হয় ওঠাবসা । দলীয় কোন পদ-পদবি না থাকলেও বিএনপির নেতাদের সাথে চলাফেরা শুরু করেছিল সে।

এদিকে নতুন করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে ভুক্তভোগীর বক্তব্য নিয়ে। স্বামী চান না বলে মামলা তুলে ফেলতে চান ভিকটিম।

তিনি বলেন, ‘আমি মামলা করেছি, আমি উঠাই ফেলবো। আমি দশজনের ভালো চাই। মামলা তুলে নিতে আমাকে কেউ চাপ দেয় নাই, টাকার লোভও দেখায় নাই। পোলার বাপে কইছে, তোর সম্মান গেছেগোই, এহন কেস করলেও পাইতি না, কোন করলেও পাইতি না তুই।’

ফজর আলীর সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক ছিল- জানতে চাইলে বলেন, ‘না না, টাকা পয়সা নিয়া কতা হইছে। টাকা নিছি। টাকা নিয়া সম্পর্ক।’

মামলার বিষয়ে বলেন, ‘মামলা করছিলাম তো ভালার লাইগা। অহন জামাইয়ে না করে। মামলাটা যখন করছি জামাই আমার লগে রাগারাগি কইরা কথা বলে নাই। গেরামের লগেও বুঝতে পারি নাই। স্বামী এইসব শুইনা, দেইখা অহন ফোনই দেয় না। ঘটনা আমার বাবার বাড়ি হইছে।’

মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মহসিন বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে বিষয়টি পরকীয়া। দীর্ঘদিন ধরে তাদের সম্পর্ক। ফজর আলী আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকনের লোক। ৫ আগস্টের পর বিএনপির সাথে মিশে রূপ বদলাতে চেয়েছিল।

গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, ফজর আলী মূলত চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকনের লোক। ৫ আগস্টের পর সে বিএনপির নাম ব্যবহার করে এলাকায় প্রভাব সৃষ্টি করছে।

মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান বলেন, ‘ভুক্তভোগীর মেডিকেল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ভিডিও করার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।

কুমিল্লা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদুল হক চৌধুরী বলেন, স্থানীয়দের হাতে আটকের পর বেদম প্রহারের শিকারের হয় ফজর আলী। এ সময় গুরুতর আহত হয়। পরে সেখান থেকে পালিয়ে যান ফজর। আহত অবস্থায়ই আত্মগোপনে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে ফজর। রোববার ভোরে রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে ফজর আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরেকটা মামলার প্রস্তুতি চলছে। ভুক্তভোগী রাজি না হলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে বলে জানান তিনি।

কুমিল্লা পুলিশ সুপার মো. নাজির আহমদ খাঁন বলেন, এ ঘটনায় মোট পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছে। দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মূল অভিযুক্ত ফজর আলীকে কুমিল্লা মেডিকেলে পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে আদালতে প্রেরণ করা হবে।