
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে প্রথমবারের মতো বসেছে বাংলাদেশি আম মেলা। বিমানে চড়ে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসা নওগাঁ ও আমের রাজধানী খ্যাত রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জের আম এখনো সতেজ। মরুর বুকে দেশীয় আম প্রবাসীদের করে তুলেছে মাতোয়ারা, আম কিনতে তাদের মধ্যে চলছে উন্মাদনা। রসালো ও মিষ্টি স্বাদের বাংলাদেশি আম মন কেড়ে নিচ্ছে মরুর শেখদেরও। আম কিনতে মেলায় ভিড় করছেন কাতারের স্থানীয় বাসিন্দারও। আমের এই মিষ্টি সুবাতাস ছড়িয়ে পড়েছে দেশটিতে বসবাসরত অন্যান্য দেশের বাসিন্দাদের মাঝেও। কানায় কানায় ঠাসা মেলা প্রাঙ্গণের প্রতিটি স্টলে বাংলাদেশি আম বিক্রির ধুম পড়েছে।
শনিবার (২৮ জুন) কাতারের রাজধানী দোহার বাণিজ্য এলাকাখ্যাত সুক ওয়াকিফে অনুষ্ঠিত সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশি ম্যাংগো ফেস্টিভ্যাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। দোহায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে গেল ২৫ জুন শুরু হওয়া এই মেলা চলবে ১ জুলাই পর্যন্ত। স্থানীয় সময় বিকেল ৪ টা থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত চলছে এই মেলা। কাতার ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রয়েছে ৫০টির মতো স্টল।
জানা গেছে, কাতারে দিনের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির উপরে থাকে। ৪৩ থেকে ৪৫ ডিগ্রির ঘরে তা উঠানামা করে। আর রাতে গিয়ে সেই তাপমাত্র ৩৪ ডিগ্রির ঘরে নামে। ফলে জনবহুল ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে ভিড় নামে বিকেল ৪টা থেকে। এসব কারণেই বাংলাদেশি আম মেলাটি বিকেল ৪টা থেকেই শুরু হয়। আর যে জায়গায় এই মেলা হচ্ছে সেই একই জায়গায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের আম মেলা। কাতারের আম বাজারে প্রতিবেশি এই দুই দেশের দাপুটে অবস্থানও রয়েছে। আর সেই স্থানটিতে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে চায় বাংলাদেশ। আর এই মেলা আয়োজনের মূল লক্ষ্যও দেশটিতে বাংলাদেশি আমকে পরিচিত করে তোলা। মেলা ঘুরে দেখা গেছে, সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে, এক ধাপ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। কাতারে বসবারত বাংলাদেশের প্রায় সবাই মেলাটি সম্পর্কে অবগত। মেলা নিয়ে আগ্রহও তাদের প্রচুর।
শনিবার বিকালে সরেজমিনে মেলা ঘুরে দেখা গেছে, মেলায় প্রবেশের মূল ফটকের ডান পাশেই রয়েছে একটি আম গাছ। সেখানে ঝুলছে নানা জাতের আম। বিশালাকার বড় একটি আমের প্রতীকী গাছটি ঘিরে দর্শনার্থীদের আগ্রহের কমতি নেই। ঝুলে থাকা বড় আম ধরে ছবি তুলছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও রয়েছেন সেই কাতারে। আর প্রতিটি স্টলে ক্রেতাদের ভিড়। কেজি প্রতি ১৫ (১ রিয়াল সমান প্রায় ৩৪ টাকা) থেকে ২০ রিয়ালে (৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি) বিক্রি হচ্ছে আম। হাফ কেজি থেকে শুরু করে ১০ থেকে ২০ কেজি আমও নিচ্ছেন কোনো কোনো ক্রেতা।
দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন জমির উদ্দিন শিমুল ও উম্মে মরিয়ম দম্পত্তি। সেলিয়া শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশি এই দম্পত্তি খুবই উচ্ছ্বসিত। সারাবাংলাকে জমির উদ্দিন শিমুল বলেন, ‘আসলে সত্যি এটা অসাধারণ। বাংলাদেশে সচারাচর আমরা নানা ধরণের মেলা পাই। বিদেশে আমরা আম মেলা পাই না। কাতারে এটা আমাদের জন্যে সর্বপ্রথম। এ কারণে আমরা আমাদের ফ্যামিলি বন্ধু-বান্ধবসহ অসংখ্য বাংলাদেশি এসেছি। পাশাপাশি আমাদের অন্য দেশি ভাইরাও এসেছেন। এটি আমাদের জন্য অবশ্যই একটি গর্ব। কাতারের স্থানীয় বাসিন্দারাও মেলায় আসছেন। তারাও আমাদের সুনাম করছেন। সর্বপ্রথম মনে হচ্ছে বাইরের কোনো দেশের কেউ আমাদের কোনো জিনিস নিয়ে সুনাম করছে। আমরা চাই, এই এমন মেলা যেন আরও বেশি বেশি হয়।’
আর শিমুলের স্ত্রী উম্মে মরিয়ম বলেন, ‘অনেক ভালো লাগছে। আমরা যেহেতু বাইরের দেশে থাকি, এখানে এই আমের মেলার মধ্যে এক খন্ড বাংলাদেশ খুঁজে পেলাম।’
কাতারে জীবনে প্রথমবারের মতো এসেছেন বরেন্দ্র এগ্রো পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল রানা। নওগাঁ থেকে মেলায় আম নিয়ে এসেছেন তিনি। কথা হলে কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাতারে প্রায় সাড়ে চার লাখ বাংলাদেশি বসবাস করে। এই মেলা প্রচুর সাড়া ফেলেছে। আমরা শুক্রবারও দেখেছি ছুটির দিনে যে পরিমাণ ভিড় ছিল, সবাই কিন্তু মেলায় ঢুকতে পারেনি। মেলার ভ্যানু পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় বাইরে অনেককেই অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা চাই মেলাটি এ বছর শুরু হলো, কিছু ভুলত্রুটি হয়তো থাকবে, সেটিকে শুধরে নিয়ে সামনের বছর আরও বড় পরিসরে মেলাটি করতে পারি। শুধু কাতারেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য যেসব দেশে প্রবাসীরা থাকেন, সেসব দেশে এমন মেলা যেন আরও বড় পরিসরে করা হয়। আমরা কাতারে এ ধরণের মেলার ধারাবাহিকতা যেন রক্ষা থাকে।’
সোহেল রানা জানান, বরেন্দ্র এগ্রো শুরু হয় ২০১৮ সালে। বর্তমানে প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে আম চাষ করেন। ২০২১ সাল থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও মধ্যপ্রাচ্যে আম রফতানি শুরু করেন। তিনি বলেন, প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় আমরা যে পরিমাণ আম উৎপাদন করি সে তুলনায় আম রফতানি হয় না। উৎপাদনের তুলনায় আম রফতানির পরিমাণ নগণ্য। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তান প্রায় এক লাখ টনের উপরে আম রফতানি করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা আমের মেলা করে। কিভাবে রফতানি বাড়ানো যায়, কিভাবে রফতানি করতে হয়, তারা সারাবছরব্যাপী সেইসব প্রশিক্ষণ দেয়। আমরা সে জায়গায় পিছিয়ে রয়েছি। ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনানের আম রফতানির ক্ষেত্রে বিমান ভাড়া বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেক হতে পারে। রফতানির ক্ষেত্রে এটি বড় বাধা। এটি যে কোন মূল্যে দূর করা উচিত।
আলউখরা শহরে পরিচালিত রাওজান সুপার মার্কেট নামের একটি স্টলও মেলায় অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সুপারভাইজার মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা সারাবাংলাকে বলেন, আমরা শুধু মেলার জন্যে আম এনেছি তা নয়। আমরা পুরো কাতারেই আম ডেলিভারি দিয়ে থাকি। আম ও সবজিজাতীয় সব কিছু ডেলিভারি দিয়ে থাকি। আমাদের সুপার মার্কেট আছে। সুপার মার্কেটের জন্যেও নিয়ে আসি, আবার পুরো কাতারে আমরা সাপ্লাইয়ার হিসাবে আম সাপ্লাই দিয়ে থাকি। মেলায় আশার চেয়ে বেশি রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা ১৪ টন এনেছি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসূর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখানে বিক্রির উদ্দেশ্যে আসিনি। আমরা কাতারের ব্যবসায়িক কমিউনিটিকে দেখাতে চেয়েছি—বাংলাদেশেও বিশ্বমানের সুস্বাদু আম উৎপন্ন হয়। এমনকি আমরা কল্পনাও করিনি, এতটা চাহিদা থাকবে। তিনদিনেই অধিকাংশ আম বিক্রি হয়ে গেছে। ১২০ টন টার্গেট থাকলেও আমরা শঙ্কিত, ফ্লাইটে নতুন আম না এলে স্টলগুলো শূন্য হয়ে যেতে পারে।’
তিনি জানান, মেলায় হিমসাগর, ল্যাংড়া, রূপালি, হাড়িভাঙ্গা, ব্যানানা ম্যাংগো, বাড়িপুরসহ ৭ থেকে ৮ ধরনের আম রয়েছে। সঙ্গে এসেছে লিচু, কাঁঠাল ও লটকনও। আমের দাম রাখা হয়েছে প্রতীকী—প্রতি কেজি ১৫ দিরহাম মাত্র। মেলায় মোহাম্মদ মনসূরের স্টল রয়েছে। সেই স্টলেও ক্রেতাদের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে।
মেলায় দেখা গেছে বেশ কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করছেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয় করে মেলার সার্বিক দেখভাল করছেন তারা।
এ বিষয়ে কমিউনিটি ভলান্টিয়ার গ্রুপের ম্যানেজার সৈয়দ আসিফ উদ্দিন জানান, ‘প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার কেজি আম বিক্রি হচ্ছে, যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ গ্রাহক বিদেশি। তারা বাংলাদেশের আম খেয়ে বিস্মিত ও সন্তুষ্ট। আমরা গর্বিত, নিজ দেশের পণ্যে এমন আন্তর্জাতিক সাড়া পেয়ে।
বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব আব্দুল্লাহ আল রাজী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আম মেলায় এই আয়োজন আমাদের জন্য একটি স্মরণীয় মুহূর্ত। সাধারণত এই ধরনের ফল উৎসব কাতারে ভারত ও পাকিস্তান করে থাকে। আমরা এবারই প্রথম এমন আয়োজন করেছি। ফল মার্কেটের বড় একটি অংশ প্রতিবেশি দেশের দখলে থাকলেও, বাংলাদেশি আমের ব্যাপক সুনাম থাকা সত্ত্বেও কাতারে প্রবেশ করতে পারিনি। এবার আমরা সেই জায়গায় এন্ট্রি নিতে পেরেছি, যা ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক।’
তিনি আরও বলেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৩০টির বেশি দেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন এবং প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ মেলায় আসছেন। কাতারের সুপারশপগুলোতে বাংলাদেশি আম পৌঁছে দিতে দূতাবাস থেকে ব্যবসায়িক সংযোগ তৈরি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে।’
সারাবাংলা