Image description

প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল থাইল্যান্ড। গতকাল শনিবার রাতেও রাজধানী ব্যাংককসহ দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে সিনাওয়াত্রাবিরোধী বিক্ষোভে জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ।

সম্প্রতি, কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থাই প্রধানমন্ত্রীর একটি ফোনালাপ ফাঁসের পর ক্ষুব্ধ হয়ে পেতংতার্নের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করছে দেশটির নাগরিকেরা। ২০২৩ সালে ফিউ থাই পার্টি ক্ষমতায় আসার পর এটিকেই সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ বলা হচ্ছে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।

গত মাসে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বিতর্কিত এক সীমান্ত অঞ্চলে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আর তা নিয়েই কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে ফোনালাপ করেন থাই প্রধানমন্ত্রী। ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব শেষ হলেও এখনো কম্বোডিয়ার রাজনীতিতে বেশ প্রভাব রয়েছে হুন সেনের। ফাঁস হওয়া ওই ফোনালাপে হুন সেনকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করেন সিনাওয়াত্রা। হুন সেনকে অনুরোধ করেন যেন তিনি থাইল্যান্ডের ‘অন্য পক্ষের’ কথা না শোনেন। অন্য পক্ষ বলতে সিনাওয়াত্রা থাই সেনাবাহিনীর এক জেনারেলকে বুঝিয়েছিলেন। ওই জেনারেল নিজেকে আকর্ষণীয় বা সাহসী দেখানোর চেষ্টা করছেন বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

গত মাসে কম্বোডিয়ার সঙ্গে সংঘর্ষ হয় যে এলাকায়, ওই এলাকার দায়িত্বে ছিলেন ওই জেনারেল। ওই সংঘর্ষে কম্বোডিয়ার এক সেনা নিহত হন। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, এই ঘটনার জেরেই হুন সেনের সঙ্গে সিনাওয়াত্রার ফোনালাপ হয়।

যে জেনারেলকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, সেই জেনারেল তাঁর সমালোচক হিসেবেও পরিচিত। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, ওই জেনারেল সম্ভবত থাই সামরিক বাহিনীর সেই অংশেরও প্রতিনিধিত্ব করেন, যারা পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা ও তাঁর পরিবারকে রাজনৈতিকভাবে অপছন্দ করেন। অতীতে এই সেনাপ্রধান থাকসিন সিনাওয়াত্রা ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান চেষ্টা বা প্রচার চালিয়েছেন।

ক্ষুব্ধ থাই জনগণের অভিযোগ—ফাঁস হওয়া ওই ফোনালাপে হুন সেনের প্রতি অতিমাত্রায় নমনীয় আচরণ করেছে পেতংতার্ন। তাদের ভাষ্য—প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর প্রভাবশালী বাবা থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেন নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। ক্রমেই পেতংতার্নের পদত্যাগের দাবি আরও জোরালো হচ্ছে।

গতকাল ব্যাংককের সেন্ট্রাল ভিক্টরি মনুমেন্টের সামনে দেশটির পতাকা ও পেতংতার্নবিরোধী স্লোগান-সংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ।

আল জাজিরার ব্যাংকক প্রতিবেদক টনি চেং বলেন, ‘খুব বড় জমায়েত হয়েছে ব্যাংককে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে পেতংতার্নের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টিকে থাকা খুব কঠিন হবে। সব শ্রেণির মানুষ জড়ো হয়ে চিৎকার করে পেতংতার্নের পদত্যাগ চাচ্ছে। কিন্তু এখন বড় প্রশ্ন, পেতংতার্নের বিকল্প কে হবেন?’

বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারীদের বেশির ভাগই ‘হলুদ শার্ট’ নামে পরিচিত একটি গ্রুপের সদস্য। হলুদ রঙের পোশাক থাই রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। তারা পেতংতার্নের বাবা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার বিরোধিতা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

ফোনালাপ ফাঁসের জেরে এরই মধ্যে পেতংতার্নের প্রধান জোটসঙ্গী রক্ষণশীল ভুমজাইথাই পার্টি গত বুধবার জোট ত্যাগ করে। পেতংতার্নের পদত্যাগ অথবা আগাম নির্বাচন ঘোষণার দাবিও জোরালো হচ্ছে। এতে থাইল্যান্ড নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতায় পড়েছে। ভুমজাইথাই পার্টির ৬৯ জন সংসদ সদস্যের সমর্থন হারানোর ফলে পেতংতার্নের পক্ষে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভুমজাইথাই পার্টির সরে যাওয়ায় ১০-দলীয় জোটের আসনসংখ্যা কমে ২৫৫ হয়েছে, যা ৫০০ আসনের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যার সামান্য বেশি।

প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা বর্তমানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তদন্তের মুখোমুখি—একটি সাংবিধানিক আদালতের, অন্যটি জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশনের। উভয় তদন্তের ফলাফলই তাঁর পদচ্যুতির কারণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাসচিব সারোতে ফুয়েনগ্রামপান গত বুধবার জানান, হুন সেনের সঙ্গে বিতর্কিত ফোনালাপের ঘটনায় পেতংতার্নের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর নীতি লঙ্ঘনের’ অভিযোগে তদন্ত চলছে। যদিও তদন্তের ফলাফল প্রকাশের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা তিনি উল্লেখ করেননি।

এদিকে সাংবিধানিক আদালত চাইলে তদন্ত চলাকালেই পেতংতার্নকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে। সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, মামলাটি গ্রহণ করবে কি না আগামী সপ্তাহের মধ্যেই সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন আদালত।

সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে পেতংতার্ন জানান, তিনি এই পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত নন এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে প্রয়োজনীয় প্রমাণ পেশ করতে প্রস্তুত। তাঁর ভাষায়, ‘ফোনালাপ থেকেই স্পষ্ট যে এতে আমি কোনো ব্যক্তিগত সুবিধা পাইনি এবং দেশের কোনো রকম ক্ষতিও করিনি।’

প্রসঙ্গত, নীতি লঙ্ঘনের অভিযোগে গত বছর পেতংতার্নের পূর্বসূরিকে দল থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন আদালত।

কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা আবারও এই দুই প্রতিবেশী দেশের দীর্ঘদিনের সীমান্ত দ্বন্দ্বকে সামনে এনেছে। পেতংতার্নের সঙ্গে ফোনালাপ ফাঁসের পর কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সিনেট প্রেসিডেন্ট হুন সেন আবারও তাঁর দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান ঘোষণা করেছেন।

রাজধানী নমপেনে অনুষ্ঠিত কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ভাষণে হুন সেন জোর দিয়ে বলেন, থাই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ছিল অবৈধ ও উসকানিমূলক। তিনি ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘দরিদ্র ও যুদ্ধবিধ্বস্ত’ অতীত পেছনে ফেলে এখন কম্বোডিয়া যেকোনো দেশের সমমর্যাদার রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যার এখন সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো শান্তি ও উন্নয়ন। হুন সেনের এমন বক্তব্যকে কেবল একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী সুরই নয়, বরং থাইল্যান্ডকে কূটনৈতিকভাবে চাপে ফেলার এক কৌশল হিসেবেও দেখছেন অনেক বিশ্লেষক।

উল্লেখ্য, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তসংক্রান্ত বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে প্রাচীন প্রেহা ভিহিয়ার মন্দির এবং এর আশপাশের একটি সীমান্ত অঞ্চল। দুই দেশই এটি নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। ১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এই বিতর্কের নিষ্পত্তি করতে রায় দেন যে ঐতিহাসিক প্রমাণ ও মানচিত্রের ভিত্তিতে প্রেহা ভিহিয়ার মন্দিরটি কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে অবস্থিত। এই রায় কম্বোডিয়া স্বাগত জানালেও থাইল্যান্ডে তা ব্যাপক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়।

এর প্রায় অর্ধশতাব্দী পর, ২০১১ সালে এই সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়, ঘটে প্রাণহানিও। পরে, ২০১৩ সালে জাতিসংঘ-সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আবারও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, শুধু মন্দিরটিই নয়, এর চারপাশের বিতর্কিত ভূখণ্ডও কম্বোডিয়ার। তবে, দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি এখনো হয়নি।