
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ভবনের কক্ষ কবজায় নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। বরাদ্দের নির্ধারিত নিয়ম-নীতি থাকলেও সে সবের তোয়াক্কা করছেন না কেউ। দখলদারদের মধ্যে আছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান অনির্বাচিত কমিটির সহ-সভাপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কর্মরতরা। তারা নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কক্ষগুলোয় আগে থেকে অবস্থান করা আইনজীবীদের নথিপত্র ছুড়ে ফেলে তাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে সমিতির পুরাতন ভবনের ১৪৭, ১২৪ ও ৩২৩ নম্বরের তিনটি কক্ষ দখল হয়ে গেছে। চর দখলের মতো করে এগুলো কব্জায় নিয়েছেন এবিএম ইব্রাহিম খলিল (১৪৭ নম্বর কক্ষ), মহিউদ্দিন এমডি হানিফ (১২৪ নম্বর কক্ষ) ও সমিতির সহ-সভাপতি সরকার তাহমিনা বেগম সন্ধ্যা (৩২৩ নম্বর কক্ষ)। তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন ও ইব্রাহিম বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। রাষ্ট্রীয় এই দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ই তারা কক্ষগুলো দখল করেছেন। তারা এসব রুমের ঠিকানা দিয়ে নিজেদের ভিজিটিং কার্ডও তৈরি করেছেন।
অ্যাডভোকেট তাহমিনা তার অনুগত বাহিনী নিয়ে কক্ষটি দখলে নেওয়ার পর বিষয়টি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন ব্যারিস্টার জোবায়ের হাসান। তিনি লেখেন, রুমটি তার মায়ের নামে বরাদ্দ ছিল। তার স্ট্যাটাসের সঙ্গে দখলের সময় রুমের ফাইলগুলো ছুড়ে ফেলা এবং ত্রাস সৃষ্টি করার ছবি এবং ভিডিও আপলোড করেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, গত ১০ মে তার মা অ্যাডভোকেট মাহমুদা বেগম ইন্তেকাল করেন। তার মা সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড ছিলেন।
তার দাবি, তার মায়ের নামে রুমটি এখনো বরাদ্দ আছে। ইন্তেকালের পর বরাদ্দ বাতিল করে কোনো নোটিস আইনজীবী সমিতি থেকে ইস্যু করা হয়নি। অন্য কাউকে রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এমন নোটিসও তারা পাননি। এছাড়া তার মায়ের ইন্তেকালের পর তারই জুনিয়র অ্যাডভোকেট তাসলিমা চৌধুরী রুমটি বরাদ্দ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। তার মা মাহমুদা বেগমের সব মামলা তাসলিমা চৌধুরী দেখাশোনা করেন। অথচ, হঠাৎ করেই গত ১৬ জুন রুমটি দখলে নেন অ্যাডভোকেট তাহমিনা। তিনি সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান অনির্বাচিত কমিটির সহ-সভাপতি পদের দাপট দেখিয়েছেন। রুম দখলের আগে তাহমিনার কাছে সমিতির অ্যালটমেন্ট লেটার দেখতে চাওয়া হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেন, সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মুখের কথাই যথেষ্ট।
ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে ব্যারিস্টার জোবায়ের আমার দেশকে বলেন, তিনি এখনো সুপ্রিম কোর্টে অ্যানরুলমেন্ট নন। তাই রুমটি তার মায়ের সরাসরি জুনিয়রকে (যিনি তার মায়ের সঙ্গে কাজ করতেন) বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। সেই আবেদনের কোনো অগ্রগতি না থাকলেও কক্ষটি দখলে নিয়েছেন অ্যাডভোকেট তাহমিনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৪৭ নম্বর রুমটি বরাদ্দ রয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে অস্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কাজী ওয়ালিউল ইসলামের নামে। এছাড়া ১২৪ নম্বর রুমটি বরাদ্দ রয়েছে একই সময়ে অস্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আইনুন নাহারের নামে। রেওয়াজ অনুযায়ী তাদের নামে বরাদ্দ বহাল থাকার কথা। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী প্রথমে দুই বছরের জন্য অস্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয় বিচারক পদে। দুই বছরের কার্যক্রম সন্তোষজনক হলেই স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই বছর পর স্থায়ী নিয়োগ না হলে আবার আইন পেশায় ফিরতে হয়। নিয়োগের আগে আইন পেশায় থাকাকালীন জুনিয়ররা মামলার তদারকি ও রুম ব্যবহারের রেওয়াজ রয়েছে। অথচ, তাদের ফাইলপত্র ও মামলার নথি ছুড়ে ফেলে দিয়ে রুমটি দখলে নেন বর্তমান সময়ের প্রভাবশালীরা।
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে আইনজীবীদের রুম বরাদ্দের নির্ধারিত নিয়ম রয়েছে। বরাদ্দের আগে আবেদন যাছাই-বাছাইয়ের জন্য অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে যাছাই-বাছাইয়ে সিনিয়রিটির মাধ্যমে রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ, ১২৪, ১৪৭ ও ৩২৩ নম্বর রুম দখলের আগে বরাদ্দ সংক্রান্ত সমিতির কোনো বৈঠক হয়নি।
গত বছরের মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনের পর বিতর্কিত ফলাফলে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে সভাপতি পদে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। সহ-সভাপতি, সম্পাদক, সহ-সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ ১০টি পদে তখন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিজয়ীরা উধাও হয়েছেন। তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিতর্কিত ফলাফলে পরাজিতরা সমিতির পদগুলোর দায়িত্ব নেন।
৩২৩ নম্বর কক্ষটি দখলে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট তাহমিনা বলেন, বরাদ্দ ছাড়া কেউ রুম দখল করেনি।
সমিতির সেক্রেটারির (সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন) পদে বসা ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন বলেন, বরাদ্দ ছাড়া কেউ কক্ষ দখলে নেয়নি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সেক্রেটারি পদ-প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘এটি সমিতির অভ্যন্তরীণ বিষয়। যেহেতু নির্বাচনের ফলাফলে জোর করে আমাকে পরাজিত দেখানো হয়েছিল, তাই ৫ আগস্টের পর আমি আর এই পদে যাইনি। সহ-সম্পাদক পদে নির্বাচনে যাকে পরাজিত দেখানো হয়েছিল, তিনি এখন সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তবে আমরা চাই সমিতির নিয়ম মেনে রুম বরাদ্দ হোক।’
সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আমরা চারজন আছি নির্বাচিত। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অন্যরা সমিতির কমিটিতে ঢুকেছেন। আমরা যারা নির্বাচিত আছি, এ বিষয়ে কিছুই জানি না। আমরা কারো নামে রুম বরাদ্দ করিনি। অন্য কেউ করে থাকলে জানি না।’