Image description
বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র » ৯ মাসেও জমা পড়েনি সাত হাজার আগ্নেয়াস্ত্র । » পাঁচ হাজারের বেশি লাইসেন্সের তথ্যে নানা অসংগতি । » অসংগতিপূর্ণ লাইসেন্সের বেশির ভাগই আ.লীগ নেতা - কর্মীদের ।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেওয়া ৫ হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় । এসব লাইসেন্সের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতা - কর্মী ও দলটির সমর্থক ব্যবসায়ীদের নামে । অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে জমা পড়া ও জমা না পড়া অস্ত্রের লাইসেন্সের তথ্য যাচাইয়ে এগুলোর কাগজপত্রে অসংগতি পাওয়ায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে । স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে । অস্ত্র জমা না দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রক্রিয়াও শুরু হচ্ছে ।

সূত্র বলেছে, সব লাইসেন্স স্থগিত করে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও এখনো ৭ হাজারের বেশি লাইসেন্সের অস্ত্র জমা পড়েনি । বাড়ি বাড়ি গিয়েও পুলিশ এসব লাইসেন্সধারী বা লাইসেন্সের বিপরীতে থাকা অস্ত্র পায়নি । ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন । তাঁদের অনেকে বিদেশে চলে গেছেন । জানতে চাইলে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ( রাজনৈতিক ও আইসিটি অনুবিভাগ ) খন্দকার মো . মাহাবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন , আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি । বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে ।

পুলিশের বিশেষ শাখার ( এসবি ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ৪৯ হাজার ৬৭১ টি লাইসেন্স রয়েছে । এগুলোর মধ্যে সাড়ে ৪৬ হাজার লাইসেন্স ব্যক্তির নামে । বাকিগুলো প্রতিষ্ঠানের নামে । ব্যক্তির নামে থাকা লাইসেন্সগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে আছে অন্তত ৮ হাজার ২০০ টি লাইসেন্স । বিএনপির নেতা - কর্মীদের নামে লাইসেন্স আছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ টি । অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নামে আছে মাত্র ৭৯ টি লাইসেন্স । বিভাগভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ঢাকা বিভাগে, ১৪ হাজার ৬৮৩ টি । সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে, ২ হাজার ১১৮ টি ।

আওয়ামী লীগের নেতা - কর্মীদের নামে থাকা লাইসেন্সগুলোর অধিকাংশ দলটি গত ১৫ বছরে ক্ষমতায় থাকাকালে দেওয়া । ছাত্র - জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার । আগস্টেই সরকার আগ্নেয়াস্ত্রের সব লাইসেন্স স্থগিত করে অস্ত্রগুলো ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় । নির্দেশনায় বলা হয় , যাঁরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অস্ত্র জমা দেননি , তাঁদের লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসেবে বিবেচিত হবে ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায় , ওই নির্দেশনার পর সারা দেশে লাইসেন্সের বিপরীতে থাকা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়েছে । তবে নির্ধারিত সময়ের ৯ মাস পরও এখনো ৭ হাজারের বেশি অস্ত্র জমা পড়েনি । জমা দেওয়া ও না দেওয়া — উভয় ক্ষেত্রের অস্ত্রের কাগজপত্র যাচাই - বাছাই করে ৫ হাজারের কিছু বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে । স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন , জমা পড়া আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে , বেশির ভাগের কাগজপত্রে অসংগতি আছে । আবার যাঁরা জমা দেননি , তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে । শেষ পর্যন্ত এসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে ।

পুলিশের এসবি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে , আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের সময়ে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেককে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয় । আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও এই সুযোগে লাইসেন্স নিয়েছেন । কেউ কেউ এসব বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিভিন্ন সময় বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতেও প্রদর্শন করেন । কেউ কেউ অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে পরে সেটিকে বৈধ বলেও দাবি করেন । সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন , আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লাইসেন্সের এসব শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে অন্যদের লাইসেন্স বাতিল হলেও দলীয় নেতা - কর্মীদের লাইসেন্স বাতিল হয়নি ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ( ডিএমপি ) রমনা বিভাগের একটি থানার সূত্র জানায় , ৩ সেপ্টেম্বর অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসবির মাধ্যমে থানায় থানায় অস্ত্র জমা না দেওয়া ব্যক্তিদের একটি তালিকা পাঠানো হয় । ওই তালিকায় অস্ত্রের লাইসেন্সধারীর নাম , ঠিকানা ও অস্ত্রসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য ছিল । তালিকার ভিত্তিতে অস্ত্র জমা না দেওয়া লাইসেন্সধারীদের বাড়ি বাড়ি যায় পুলিশ । তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের পাওয়া যায়নি । অস্ত্রও পাওয়া যায়নি । প্রায় একই কথা বলেছেন ডিএমপির আরও কয়েকটি থানা , গাজীপুর , কুষ্টিয়া , চট্টগ্রাম , সিলেট , নেত্রকোনা , টাঙ্গাইলসহ একাধিক জেলার বিভিন্ন থানার কর্মকর্তারা ।

সূত্র জানায় , লাইসেন্স পেয়ে অত্যাধুনিক পিস্তল ও শটগান কেনেন রাজধানীর হাতিরঝিল - রমনা থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল কবির । লাইসেন্স আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ( ডিএনসিসি ) সাবেক কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন তিতু , সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নুনু মিয়া , যুবলীগের নেতা জাহিদুর ইসলাম সুজন , সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো . মোখলেছুর রহমান কামরান , টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান সোহেল , ফরিদপুর শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সেলিম হাসান , নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা জাহিদুর ইসলাম সুজনের । তাঁরা কেউ অস্ত্র জমা দেননি । আওয়ামী লীগের আমলে কুষ্টিয়া জেলায় ২৬২ টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয় । এর মধ্যে ২০১০ , ২০১২ ও ২০১৩ সালে সবচেয়ে বেশি লাইসেন্স দেওয়া হয় । লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা , আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার । লাইসেন্সের বিপরীতে কেনা অস্ত্রগুলোরও বেশির ভাগ জমা পড়েনি ।

কুষ্টিয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান , কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান তাঁর লাইসেন্স করা পিস্তল জমা দেননি । তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই ।

জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক ( আইজিপি ) বাহারুল আলম বলেন , নির্ধারিত সময়ে যাঁরা অস্ত্র জমা দেননি , তাঁদের কাছে থাকা অস্ত্র এখন অবৈধ । আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে এসব অবৈধ অস্ত্র শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে সেগুলো উদ্ধার করা । পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালিয়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে চেষ্টা করছে ।

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান ড . মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন , অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল । অস্ত্র ব্যবহার না করলেও প্রদর্শন করাটা এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে । এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার । তিনি বলেন , যাঁরা নির্দেশ অমান্য করে অস্ত্র জমা দেননি বা ভুয়া তথ্য দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছেন , তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সময়ের দাবি । না হলে এসব অস্ত্রের অপব্যবহার হতে পারে । সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে ।