
মানিকগঞ্জের মেয়ে তানিশা রহমান। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় দ্যুতি ছড়াত। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হওয়ার। তার প্রতিটি পরীক্ষার ফল ছিল অনেক সহপাঠীর কাছে ঈর্ষণীয়। আর এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিচ্ছিল পরম যত্নে। নির্বাচনী পরীক্ষায় ভালো ফল করে শিক্ষকদের আশাবাদী করে তোলে সে। ফরম পূরণও সম্পন্ন করেছিল যথাসময়ে। তারপরই জীবনের ছন্দপতন। তানিশা দেখতে সুন্দর। অষ্টম শ্রেণি থেকেই বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। গ্রামের সমাজব্যবস্থার চাপে তার পরিবার প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তথাকথিত সামাজিক রীতি (মেয়ের বয়স হয়ে গেছে, বিয়ে দিতে হবে, নইলে পরে বিয়ে হবে না) তার পরিবারের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছিল। বাবা-মা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। দেশের অস্থির পরিস্থিতি তাদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে তোলে। এসএসসি পরীক্ষার মাত্র এক মাস আগে তানিশার বিয়ে ঠিক হয়। পাত্র তার থেকে ১২ বছরের বড়। সংসারের দায়িত্ব আর শ্বশুরবাড়ির অনিচ্ছার কারণে তার স্বপ্ন নিভে যায়।
শুধু তানিশা নয়, সম্প্রতি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এক জরিপে উঠে এসেছে বাল্যবিয়ের কারণে দেশের মেয়েদের শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ার এক ভয়াবহ চিত্র। ২০২৫ সালে এ বোর্ডের অধীনে থাকা ১৩টি জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছে একটি গুগল ফর্ম পাঠানো হয়। এ ফর্মে অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে সশরীরে বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়। তথ্য সংগ্রহকারীরা পরীক্ষা না দেওয়ার কারণ এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—এ দুটি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। জরিপের সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো অনুপস্থিতদের মধ্যে ৪২ শতাংশ অনুপস্থিত ছিল বিয়ের কারণে, যা মোট অনুপস্থিতির কারণগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ৯৭ শতাংশ মেয়ে। বিয়েজনিত কারণে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের ৮৭ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের এবং ১৩ শতাংশ শহর অঞ্চলের।
চলতি বছর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৮৫ পরীক্ষার্থী ফরম পূরণ করলেও পরীক্ষা শেষে ৬ হাজার ৩৮৯ জন অনুপস্থিত ছিল। জরিপে ১ হাজার ৩৫০ জন অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে শুধু আর্থিক অসচ্ছলতাকে ঝরে পড়ার প্রধান কারণ হিসেবে জানা গেলেও বিয়ের কারণে এত বেশি হারে শিক্ষার্থী ঝরে পড়াটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। ১০ বছর পড়াশোনার পর ফরম পূরণ করেও বিয়ে বা আর্থিক সংকটে পরীক্ষা দিতে না পারাটা দুর্ভাগ্যজনক।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার কালবেলাকে বলেন, শিক্ষার সার্বিক ঝরে পড়ার হার নিয়ে বিভিন্ন জরিপ হলেও ফরম পূরণ করেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে এর আগে কোনো জরিপ হয়নি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এবারই প্রথম এ ধরনের জরিপ পরিচালনা করেছে। সেই জরিপে ঝরে পড়ার হার, কারণ, সুপারিশসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রতিবেদন আকারে দেওয়া হয়েছে।
জরিপে বিয়ের কারণ ছাড়াও অনুপস্থিতদের মধ্যে গর্ভধারণের কারণে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, অসুস্থতার কারণে ২৫ শতাংশ, ভালো প্রস্তুতি না থাকায় ১২ শতাংশ, পারিবারিক অসচ্ছলতা কারণে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, বিদেশ চলে গেছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, মৃত্যুজনিত কারণে ১ দশমিক ৪ শতাংশ, পরিবারের অন্য সদস্যের অসুস্থতার কারণে ১ দশমিক ৬ শতাংশ অনুপস্থিত ছিল। অন্য কারণে অনুপস্থিত ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। জেলাভিত্তিক বাল্যবিয়ে এগিয়ে আছে গাজীপুর (৪৯ শতাংশ), নরসিংদী (৪৭ শতাংশ), মাদারীপুর (৫৪ শতাংশ), নারায়ণগঞ্জ (৪৩ শতাংশ), মানিকগঞ্জ (৬৫ শতাংশ), ঢাকা জেলায় (২৬ শতাংশ), ফরিদপুর (৩৭ শতাংশ), শরীয়তপুর (৪৪ শতাংশ), গোপালগঞ্জ (৪২ শতাংশ), কিশোরগঞ্জ (৪৩ শতাংশ), টাঙ্গাইল (৩৮ শতাংশ), রাজবাড়ী (৪৪ শতাংশ) ও মুন্সীগঞ্জে (৩৯ শতাংশ)।
জরিপের ফল অনুযায়ী, পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে মানবিক বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ৬৮ শতাংশ। ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ থেকে ২৪ শতাংশ এবং বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। অর্থাৎ বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। এ ছাড়া অনুপস্থিতির হারে লিঙ্গ ও অঞ্চলভেদে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা গেছে। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ মেয়ে এবং ৩১ শতাংশ ছেলে অনুপস্থিত ছিল, যা বাল্যবিয়ের একটি বড় প্রভাবকে তুলে ধরে। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ এবং অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ অনুপস্থিত ছিল।
জরিপে আরও কিছু উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর মধ্যে রয়েছে সমতল অঞ্চলের ৮৯ শতাংশ, চর অঞ্চলের ৮ শতাংশ এবং হাওর অঞ্চলের ৩ শতাংশ। ১ হাজার ৩৫০ জন অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী। তাদের প্রায় ৫১ শতাংশ বলেছে, আর পড়াশোনা করবে না। যারা বলেছে আর পড়াশোনা করবে না, তাদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ হচ্ছে মেয়ে শিক্ষার্থী।
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ অনুযায়ী, ২১ বছর পূর্ণ করেননি—এমন ছেলে এবং ১৮ বছর পূর্ণ করেননি—এমন মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে বিপুলসংখ্যক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে বাল্যবিয়ের শিকার হতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফাহমিদা সুলতানা বলেন, এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বিয়েজনিত কারণে শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাওয়া নারী শিক্ষার অগ্রগতির পথে এক বিরাট বাধা। এর পেছনে কয়েকটি কারণ সুস্পষ্ট। প্রথমত, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন থাকা সত্ত্বেও এর যথাযথ প্রয়োগের অভাব। গ্রামাঞ্চলে সামাজিক সচেতনতা এখনো ততটা বাড়েনি। দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্য একটি বড় কারণ। তৃতীয়ত, কভিড-১৯ পরিস্থিতি অনেক পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে দিয়েছে, যা বাল্যবিয়ের প্রবণতা বাড়িয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ প্রফেসর মনজুর আহমেদ বলেন, এ জরিপের ফল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি অশনিসংকেত। ১০ বছর পড়াশোনার পর এসএসসি ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা দিতে না পারাটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এ সামাজিক ব্যাধি থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বাল্যবিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির সমস্যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এটিকে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, যা সমাজের একটি জটিল দিককে তুলে ধরছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যেক শিক্ষার্থী গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
বাল্যবিয়েকে তিনি একটি সামাজিক জটিলতা হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, ‘যদি একজন মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়, তবে কিছুদিনের মধ্যেই সে মা হয়ে যায়। অল্প বয়সে মাতৃত্ব শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে।’
ড. রহমানের মতে, সরকারকে অবশ্যই এ সমস্যার পেছনের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং উপযুক্ত সমাধান গ্রহণ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, মেয়েরা ‘বড় হওয়া’ মানেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া—একটি সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। তারা মনে করে, মেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য পড়াশোনা শেষ না করলেও হবে। পাশাপাশি অনেক পরিবার অর্থনৈতিক অক্ষমতার কারণে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারে না। দিনমজুর পরিবারগুলোর প্রধান লক্ষ্য থাকে খাবার জোগাড় করা; সেখানে শিক্ষা উপকরণ কেনা তাদের কাছে অসম্ভব। ফলে তারা মেয়েদের বিয়ে দেওয়াকে এক ধরনের সমাধান মনে করে।
তিনি বলেন, বর্তমানে আরও কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। অল্প বয়সে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, সঙ্গদোষে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হওয়া এবং মাদকাসক্তির মতো সমস্যাগুলোও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও অনেক ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষকদের ভূমিকা, পাঠদান পদ্ধতি, এবং শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দময় ও উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে না পারার কারণে তারা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তারা বলছে, পড়াশোনা ভালো লাগে না, কোনো মজা পায় না। এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমাতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। বর্তমান বৃত্তির পরিমাণ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ সমস্যা সমাধানে আর্থিকভাবে সুরক্ষা নিশ্চিত করা, আয়বর্ধনমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এবং পরিবার ও সমাজকে সচেতন করে তোলা দরকার। রাষ্ট্রীয় নীতিমালার মাধ্যমে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা গেলে এ প্রবণতা অনেকটাই কমানো সম্ভব।