দফায় দফায় মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন বন্ধের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এর আগে ২০২৩ সালের মে মাসেও জারি করা হয়েছিল। যদিও তা পরে স্থগিত করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর ৬ মাস সময় বেঁধে দিয়েছিল সড়ক থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন অপসারণের জন্য। কিন্তু কার্যত মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-লেগুনা কিংবা ট্রাকের মতো যানবাহনগুলো সড়ক থেকে কোনোভাবেই সরানো যাচ্ছে না। বরং এসব যানবাহনের কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নতুন রঙ করে সড়কে ছেড়ে দেয়া হয় আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া যানবাহনগুলো। কেন সরানো যাচ্ছে না এ সকল যানবাহন? সরকার বলছে মালিকদের অনীহা। সড়ক নিয়ে কাজ করা একাধিক বেসরকারি সংগঠন ও বিশেষজ্ঞ বলছেন সরকারের আইন প্রয়োগেও রয়েছে ঘাটতি। প্রশ্ন উঠেছে বিআরটিএ’র সক্ষমতা নিয়েও।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান মানবজমিনকে বলেন, বারবার নির্দেশনা দিয়েও সড়ক থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন না সরানোর একটি কারণ হচ্ছে- মালিকদের অনীহা। আমরা আসলে মালিকদেরই বলছি যে আপনারা এগুলো নিয়ে নেন। নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না আমরা। আমরা প্রজ্ঞাপন দিয়েছি, জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে গাড়িগুলো সরানোর বিষয়ে। আগে আমরা সময় বেঁধে দিলেও ঈদের জন্য কার্যকর করা যায়নি। যাতায়াতের সময় ভোগান্তির বিষয়টা আমরা মাথায় নিয়েছি। আমরা এ জন্য সময় দিলাম। পাশাপাশি বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানকে বদলি করা হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন যদি না সরে তাহলে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এগুলো বাতিল করে ডাম্পিংয়ে পাঠিয়ে দেবো।
গত এপ্রিলের শেষে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন সরানোর বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিআরটিএ। সেখানে বলা হয়- ঢাকা মহানগরী থেকে পুরনো বাস, মিনিবাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ এই ধরনের মোটরযান অপসারণ করা হবে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ঢাকা মহানগরী থেকে এসব মোটরযান অপসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মে মাস থেকে ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস, মিনিবাস এবং ২৫ বছরের বেশি পুরনো ট্রাক, কাভার্ডভ্যান প্রভৃতি মালবাহী মোটরযান ঢাকা মহানগরী থেকে অপসারণ করতে হবে। সম্প্রতি ফের যানবাহনের ইকোনমিক লাইফ বা অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। যা আগামী ১লা জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে সরকার। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে- সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ধারা ৩৬এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে ২০ বছর এবং ট্রাক, কাভার্ডভ্যান প্রভৃতি মালবাহী মোটরযানের ক্ষেত্রে ২৫ বছর ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করলো। এর আগে, ২০২৩ সালে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনেও একই বিষয় জানানো হয়। সেখানেও বলা হয়েছিল- বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০২৩ সালের মে মাসের এক প্রজ্ঞাপনে- বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও ট্যাংকারের ইকোনমিক লাইফ (অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল) নির্ধারণ করা হয়। এতে বলা হয়, বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল হবে ২০ বছর ও ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের ২৫ বছর।
ওদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ই আগস্ট গঠিত নতুন সরকারের আমলে ‘যানজট ও বায়ুদূষণ’ নিরসনে পুরনো যানবাহন উঠিয়ে দেয়াসহ পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে দুই দফা বৈঠক হয়। একটি ২৪শে অক্টোবর ও অন্যটি হয় ১৯শে ডিসেম্বর। বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর একটি হলো- ছয় মাস পর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়া যানবাহনের নিবন্ধন বাতিল করে সড়ক থেকে প্রত্যাহার এবং সেগুলো ডাম্পিং স্টেশনে পাঠিয়ে ধ্বংস করে দিতে হবে। কিন্তু সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও সড়ক থেকে কোনো ভাবেই সরানো যায়নি মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনগুলো। এ বিষয়ে চলতি বছর ঈদুল আজহার আগে সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমে বলেন, আমরা ঈদের সময়টা একটু দেখতে চাই। এখন আমরা সীমিত পরিসরে পুরনো যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়ক থেকে এসব গাড়ি সরছে না কারণ তারা বিআরটিএ কে গুরুত্ব দেয় না। বিআরটিএ’র ক্ষমতা নাই। তাদের জনবল নেই। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এখন রাজনৈতিক বড় দল বিএনপি। এখন সড়ক নিয়ন্ত্রণ করে বিএনপিপন্থি পরিবহন শ্রমিকরা। সুতরাং বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আওয়ামী লীগের সময় এটা তারা করেছে। ক্ষমতাসীন দলের হাতে গণপরিবহন চলে যায়। সুতরাং এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানদের পরিবহন নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। বিআরটিএ’র সাংগঠনিক সংস্কার করতে হবে। সক্ষমতা যেহেতু নেই, যানবাহন সরানোর সিদ্ধান্ত নিলে পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট করবে, জনগণের ভোগান্তি হবে, সব অচল হয়ে যাবে। সরকারের নিজস্ব গণপরিবহন থাকলেও সমস্যা ছিল না। বিআরটিসি নামের একট প্রতিষ্ঠান আছে, তার কিছুই নেই। জনগণের করের টাকা দিয়ে গাড়ি কেনা হয়, সে বাসগুলো নষ্ট করে ডাম্পিংয়ে ফেলে দেয়া হয়। ভাড়ায় খাটে তারা। সাধারণ যাত্রী পরিবহন তারা করে না। বাস মালিকরা তার মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি রাখতেই চাইবে। কিন্তু সরকারকে এটা সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু বাস মালিকরা কোনো কিছু শুনছেন না। আমাদের দেশে আইন না মানার একটা সংস্কৃতি চলে আসছে। তারা জানে আইন না মানলে শাস্তি হবে না। তাছাড়া সব রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার মধ্যেও সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি নেই। রাজনৈতিক দলগুলো যদি চাইতো এক সপ্তাহের মধ্যে এটা সমাধান হয়ে যেতো। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দেশের সড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি বন্ধ হচ্ছে না কারণ সরকার আসলে এ সকল গাড়ির বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেই। তাছাড়া এখানে রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িত। সরকার এবং মালিকদের সমন্বিত উদ্যোগ নিলে যানবাহনগুলো সড়কে চলতো না।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেগুলোকে সড়ক থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এগুলো থেকে যাচ্ছে, হয়তো চালকরা বিভিন্ন প্রভাব বিস্তার করে চালাচ্ছে। বিআরটিএ এবং পুলিশের অভিযানের মাধ্যমে সড়কে গিয়ে অথবা বিভিন্ন টার্মিনালে গিয়ে এগুলো চিহ্নিত করতে হবে। যদি এরকম যানবাহন পাওয়া যায় সেগুলোকে বাতিল করে দেয়া অথবা ভাঙাড়ি হিসেবে বিক্রি করে দেয়া দরকার। যাতে এগুলো রাস্তায় না আসতে পারে। প্রজ্ঞাপন দেয় সরকার। আমি মনে করি এসব প্রজ্ঞাপনের অ্যাকশনও থাকতে হবে। কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থা না নেয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলছে। এখানে তো জরিমানার বিষয় নেই। সরাসরি ডাম্পিং করতে হবে।
বিআরটি বলছে, দেশে নিবন্ধিত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৭৬ হাজার ২৮১টি। এর মধ্যে ২৮ হাজার ৭৬১টি বাস-মিনিবাসের বয়স ২০ বছরের বেশি। ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ বাস-মিনিবাসেরই আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। এ ছাড়া নিবন্ধিত ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও ট্যাংকলরির সংখ্যা ৩ লাখ ৭২ হাজার ১৭৪। এর মধ্যে ২৫ বছরের চেয়ে বেশি পুরনো এ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৪৮১