
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এখন ধারণক্ষমতার তিন গুণের বেশি বন্দী রয়েছেন। থাকতে হচ্ছে গাদাগাদি করে। এ পরিস্থিতি দূর করতে একটি নতুন কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পাঁচ বছরেও জমি মেলেনি। কারা অধিদপ্তর একাধিকবার তাগাদা দিলেও অগ্রগতি হয়নি।
কারা সূত্র জানায়, সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুরে নতুন কারাগারের জন্য জমি নির্বাচন করা হলেও দখলে থাকায় সেটি অধিগ্রহণ করা যায়নি। এখন নতুন জমি খোঁজা হচ্ছে।
কারা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে তিন গুণের বেশি বন্দী রয়েছেন। বারবার অনুরোধ করেও নতুন কারাগারের জন্য জমি পাচ্ছি না। নতুন কারাগার হলে সেটিকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তোলা যাবে, যেখানে বন্দীদের জন্য প্রশিক্ষণ, মৎস্য ও পোশাকশিল্পের শ্রমিক হিসেবে তৈরি করার ব্যবস্থা থাকবে।’
কারা সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের অক্টোবরে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্বাক্ষরিত একটি চিঠি চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। তাতে সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে কমপক্ষে ৭৫ একর জমি চিহ্নিত করে অধিগ্রহণের অনুরোধ করা হয়। এর আগেও ২০১৯ সালের অক্টোবর, ২০২০ সালের আগস্ট ও ২০২১ সালের জুনে মোট চার দফায় জমি চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়।
বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে তিন গুণের বেশি বন্দী রয়েছেন। বারবার অনুরোধ করেও নতুন কারাগারের জন্য জমি পাচ্ছি না। নতুন কারাগার হলে সেটিকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তোলা যাবে, যেখানে বন্দীদের জন্য প্রশিক্ষণ, মৎস্য ও পোশাকশিল্পের শ্রমিক হিসেবে তৈরি করার ব্যবস্থা থাকবেকারা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, জায়গার অভাবে বন্দীদের দিয়ে পরিচালিত বাগান, মাছ চাষ, আসবাব তৈরিসহ উৎপাদনমূলক কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত বন্দীদের স্বল্প জায়গায় রাখতে গিয়ে তাঁদের নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে।
২০২১ সালের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর, হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ, কর্ণফুলীর শিকলবাহা ও চর পাথরঘাটা, পটিয়ার ফকিরহাট এবং বোয়ালখালীর মিলিটারি ব্রিজসংলগ্ন এলাকা পরিদর্শন করে। চট্টগ্রাম আদালত ভবন, মেডিকেল কলেজ ও পুলিশ লাইনের দূরত্ব বিবেচনায় জঙ্গল সলিমপুরকে উপযুক্ত মনে করা হয়। এখান থেকে আসামিদের আদালতে আনা-নেওয়াও সহজ হতো।
২০২২ সালের ২৩ জুন তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক জঙ্গল সলিমপুর এলাকাকে ১১টি ভাগে বিভক্ত করে কেন্দ্রীয় কারাগার-২, মডেল মসজিদ, নভোথিয়েটারসহ বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনার কথা জানান। পরে জেলা প্রশাসন ও কারা অধিদপ্তরের মধ্যে চিঠি-চালাচালিও হয়।
সরকারি জমি দখল করে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। উচ্ছেদে গেলে আমাদের ফিরে আসতে হয়।’জেলা প্রশাসনের রাজস্ব ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার আলাউদ্দিন
তবে চলতি বছরের মার্চে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন জানায়, জঙ্গল সলিমপুরের জমিগুলো দখলে আছে। উদ্ধার না হওয়ায় তা কারা কর্তৃপক্ষকে দেওয়া যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসনের রাজস্ব ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি জমি দখল করে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। উচ্ছেদে গেলে আমাদের ফিরে আসতে হয়।’
এ অবস্থায় চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ নতুন করে জমি খুঁজছে। ২৫ মার্চ জেলার আনোয়ারা উপজেলায় সম্ভাব্য জমি পরিদর্শন করেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক ইকবাল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গল সলিমপুর হলে ভালো হতো। কিন্তু জেলা প্রশাসন জায়গাটি দিতে পারছে না বলে জানিয়েছে। তাই আদালত, হাসপাতাল ও পুলিশ লাইনসের কাছে ভালো যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে—এমন ৩০ থেকে ৫০ একর জমি খোঁজা হচ্ছে।
জমি নির্বাচনে এত দেরি কেন হচ্ছে—এমন প্রশ্নে ইকবাল হোসেন বলেন, জঙ্গল সলিমপুর প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ছিল; কিন্তু এখন সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। দ্রুতই নতুন একটি জায়গা নির্ধারণ করে কারা অধিদপ্তরে পাঠানো হবে।
কারা সূত্র জানায়, ১ হাজার ৮৫৩ বন্দীর ধারণক্ষমতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গড়ে প্রতিদিন ৬ হাজার বন্দী থাকেন। তাঁদের মধ্যে সাধারণ ও দুর্ধর্ষ বন্দীদের আলাদা রাখার বিষয়ে তদন্ত কমিটি সুপারিশ করলেও স্থান সংকুলানের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
২০২১ সালের ৬ মার্চ এই কারাগার থেকে হত্যা মামলার আসামি ফরহাদ হোসেন দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ঘটনায় তদন্ত কমিটি অতিরিক্ত বন্দীর চাপ সামাল দিতে না পারার বিষয়টি তুলে ধরে জেলা ও মহানগর থানার মামলার আসামিদের আলাদা রাখার সুপারিশ করে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র ও বিএনপির নেতা শাহাদাত হোসেন রাজনৈতিক মামলায় কারাভোগ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারাগারে বন্দীদের অতিরিক্ত চাপ। আমি দেখেছি, ৩০-৪০ জনের জায়গায় ১০০ জন রাখা হয়। এটা অমানবিক। বন্দীদের পর্যাপ্ত জায়গা ও ওয়াশরুম না থাকায় তাঁরা নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হন। ন্যূনতম মৌলিক অধিকার ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে চট্টগ্রামে নতুন কারাগার নির্মাণ জরুরি।’
কারা সূত্র জানায়, ১ হাজার ৮৫৩ বন্দীর ধারণক্ষমতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গড়ে প্রতিদিন ৬ হাজার বন্দী থাকেন। তাঁদের মধ্যে সাধারণ ও দুর্ধর্ষ বন্দীদের আলাদা রাখার বিষয়ে তদন্ত কমিটি সুপারিশ করলেও স্থান সংকুলানের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
কারা প্রশাসনের সাবেক উপমহাপরিদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বন্দী থাকায় দ্রুত নতুন কারাগার নির্মাণ দরকার। সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে হলে খেলাধুলা, প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা, সাক্ষাৎ, নিরাপত্তা ও আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।