
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অগ্রগতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, উচ্চকক্ষ গঠন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) ইস্যুতে এখনো স্পষ্ট ঐকমত্য তৈরি হয়নি রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে। এ ছাড়াও অধিকাংশ মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে একমত হতে পারেনি দলগুলো। আংশিক ঐকমত্যে পৌঁছালেও মৌলিক সংস্কার সিদ্ধান্ত নিয়ে মতপার্থক্য কাটছে না। দ্বিতীয় দফার ষষ্ঠদিনের বৈঠকে বিএনপি জানিয়েছে, দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন এ বিষয়ে একমত দলটি। তবে এনসিসি নাম পরিবর্তন করে যে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ কমিটি নামের প্রস্তাব করা হয়েছে এ বিষয়ের সঙ্গে একমত নন তারা। কমিশনের আলোচনা নিয়ে আশাবাদী হলেও অগ্রগতি ধীর গতিতে হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
দ্বিতীয় দফার বৈঠকে অমীমাংসিত ও মতানৈক্যর বিষয়গুলোকে নিয়ে আলোচনা করেছে কমিশন। এ আলোচনায় খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি বলেও জানিয়েছে দলগুলো। এদিকে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) সংশোধিত নাম ও কাঠামো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ নামে নতুন এ কাঠামো থেকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতির নাম বাদ দেয়া হয়েছে। সংশোধিত প্রস্তাবে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি সভায় সভাপতিত্ব করবেন নিম্নকক্ষের স্পিকার। আর কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, নিম্ন ও উচ্চকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, প্রধান বিরোধী দল ব্যতীত অন্যান্য দলের একজন প্রতিনিধি, প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি (আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত যোগ্যতাসম্পন্ন), প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের একজন কর্মকর্তা।
ঐকমত্য কমিশনের ষষ্ঠদিনের আলোচনায় বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) কিংবা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটির বিষয়ে বিএনপি একমত নয়।
তিনি বলেন, আমাদের কথা হলো- কেন সংবিধানের এই একটা বডি যুক্ত করতে চাচ্ছে। রাষ্ট্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য যেসব আইন আছে, সেগুলো সংস্কার করে সার্চ কমিটি করা হোক, সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য বিধানগুলো সংযুক্ত করা হোক। আইন না থাকলে আইন করা, আইন থাকলে শক্তিশালী করা হোক।
সালাহউদ্দিন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীন নির্বাচন করে এবং জুডিশিয়ারি যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে, তাহলেই গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। এগুলো না করে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কার্টেল করতে হবে- এ ধারণা থেকে বের হতে হবে। এজন্য নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করার মানে হয় না। এজন্য আমরা এখানে একমত হতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ জীবদ্দশায় ১০ বছরের বেশি হবে না, এ বিষয়ে একমত। তবে এনসিসি’র মতো কোনো কমিটি দিয়ে যদি নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কার্টেল করা হয়, তাহলে আমরা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে একমত থাকতে পারবো না।
ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের মানবজমিনকে বলেন, অনেকগুলো সংস্কার নিয়ে সবাই ঐকমত্য হলেও কিছু মৌলিক সংস্কারে এখনো ঐকমত্য হয়নি, এ বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতি রয়েছে। আশা করছি জুলাইয়ের মধ্যে সবাই ঐকমত্যে আসবে। দু’দিন দলগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ চেয়েছেন। এনসিসি নিয়ে বিএনপি’র দ্বিমত রয়েছে। এনসিসি’র নাম নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিএনপি’র মতের সঙ্গে যেগুলো মিলে যাচ্ছে, সেগুলোতে সহজে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাচ্ছে- বাকিগুলোতে আলোচনা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্য না হলে কি হবে? এ বিষয়ে সমাধানে কমিশন থেকে ৬টি সুপারিশ রয়েছে গণভোট, গণপরিষদ এবং সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাহী প্রজ্ঞাপন জারি। এগুলোর মধ্যে গণভোট হচ্ছে সবচেয়ে সহজ প্রক্রিয়া। যদিও এটি বাজেট ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। জনগণের মতামত প্রকাশের সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম গণভোট।
ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলছে। মৌলিক কিছু বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হওয়া যায়নি। উচ্চকক্ষে সবাই পিআর পদ্ধতি চায়, কিন্তু বিএনপি এ বিষয়ে দ্বিমত জানিয়েছে। সবাই তো আর সব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবে না, সবাইকেই ছাড় দিতে হবে। আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে ছাড় দিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাই জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন হোক। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কাছাকাছি মতে পৌঁছালে ঐকমত্য গঠন সহজ হবে। মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্য না আসলে জনগণের মতামত নিতে হবে। কেউ যেন সংস্কারগুলো পরিবর্তন না করতে পারে- সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবেন, সেখানে উল্লেখ করা থাকবে তারা কোনগুলোতে একমত এবং কোনগুলোতে দ্বিমত। অতীতে জাতীয় সনদ না থাকায় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সুবিধার্থে সংবিধান সংস্কার করেছে। জাতীয় সনদ হয়ে গেলে কেউ আর সংস্কার কার্যক্রম পরিবর্তন করতে পারবে না।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, মৌলিক সংস্কারগুলোতে এখনো ঐকমত্য হওয়া যায়নি। মৌলিক সংস্কারে অধিকাংশ দল একমত হলেও দুই-তিনটি দল ঐকমত্য হয়নি, তবে আলোচনা অগ্রসর রয়েছে। আলোচনা চলতে থাকলে ৫ই আগস্টের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট নিয়ে বেশ কিছু মতবিরোধ রয়েছে, কিছু কিছু রাজনৈতিক দল বলেছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট হলে এনসিসি’র প্রয়োজন নেই, আর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট না হলে এনসিসি গঠনের উপর মত দিয়েছে।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ মানবজমিনকে বলেন, সব বিষয়ে ঐকমত্য সম্ভব নয়। যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়েই ‘জুলাই সনদ’ প্রণীত হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে আমরা ঐকমত্যের বাইরে। গত ৬-৭ দিন যে আলোচনা হলো, আমরা বাকি কোনো প্রশ্নেই একমত হতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রীর সময়সীমা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, উচ্চকক্ষ সংখ্যানুপাতি হারে হবে, নারী আসনের ১০০তে প্রত্যক্ষ নির্বাচন। এইসব বিষয় আলোচনা হয়েছে, মনে হয়েছে কিছুটা কাছাকাছিও কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে একমত হওয়া যায়নি। চেষ্টা করছি আরেকটু ঐকমত্যে আসার। না হলে যেগুলো ঐকমত্য হবে সেটাই জুলাই সনদের ভিত্তি হবে।
তিনি আরও বলেন, শর্ত সাপেক্ষে আমরা এনসিসি গঠনের পক্ষে। সশস্ত্র বাহিনীর নিয়োগ এটা এনসিসি’র বাইরে, এটা কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান না ফলে এনসিসি’র এখানে করণীয় নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবিধানিক পদ হলেও তাদের সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হয়। এজন্য তাদেরও বাইরে রাখা দরকার। এনসিসি’র কাঠামোতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে রাখা উচিত না। তাদের বিতর্কের বাইরে রাখা উচিত। এগুলো নিয়ে বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে মতানৈক্য আছে।
উল্লেখ্য, এর আগে প্রথম দফার বৈঠকে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯শে মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ওই পর্যায়ে ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করে ঐকমত্য কমিশন। এরপর ঐকমত্যে আসতে সর্বশেষ ২৫শে জুন পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় ষষ্ঠ দিনের মতো টানা বৈঠক করেছে কমিশন।