
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্র সংস্কারের। এরই ধারাবাহিকতায় মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে এসব কমিশনের প্রস্তাব গ্রহণ ও বাস্তবায়নে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ কমিশনের উদ্যোগে সংবিধান, নির্বাচনসহ রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোয় নানাবিধ সংস্কারে দফায় দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলছে সংলাপ। এ সংলাপে অন্যতম আলোচনার বিষয় প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল। এ ক্ষেত্রে সবগুলো দলই মোটামুটি একমত হয়েছে যে, একজন সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক আমাদের সময়কে বলেন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কোথাও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার বিধান আছে বলে আমার জানা নাই। পৃথিবীর কোনো সংবিধানে আছে কি না, তাও জানি না। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় আছে। সেখানে রাষ্ট্রপতির অগাধ ক্ষমতা। আবার রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা মন্ত্রিপরিষদের থাকে। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এ রকম বিধান নেই।
এদিকে গত বুধবার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এক ব্যক্তি সারা জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন- এ প্রস্তাবের সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে একমত বিএনপি। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) বা এ ধরনের কোনো কমিটি গঠনের বিধান সংবিধানে যুক্ত করা যাবে না।
বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন এর পরিবর্তে নতুন মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’র সুপারিশ করেছিল।
এতদিনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো মূলনীতির বিষয়ে একমত হতে না পারায় একটি সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সেখানে মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’র কথা বলা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে ৯ সদস্যের এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন। ওই সময় বলা হয়েছিল- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে উভয়কক্ষের কোনো একজন সংসদ সদস্য এনসিসিতে থাকবেন। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল- সব সাংবিধানিক সংস্থার কমিশনারদের নিয়োগ করা হবে এনসিসির কাজ। এই এনসিসি গঠনের বিপক্ষে বিএনপিসহ কয়েকটি দল।
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. শাহদীন মালিক বলেন, এনসিসি গঠনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে এনসিসিতে প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার থাকবেন। আইন, বিচার ও শাসন- এই তিন বিভাগ এক হয়ে গেলে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? কোনো একটা সিদ্ধান্ত দিলেন প্রধান বিচারপতি। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কি হাইকোর্টে যেতে পারব? এ ব্যবস্থাগুলো কোথাও নেই। প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমে আছে। শ্রীলংকায় আছে সাংবিধানিক কাউন্সিল। ওরা ১০ বছরে তিনবার সংশোধন করেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য বার বার সংশোধন করা হয়েছে।
শাহদীন মালিক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর বিএনপি মেনে নিচ্ছে। এসব আলোচনা অর্থহীন। একদিকে বলছেন, ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেবেন। ৭০ অনুচ্ছেদে অনাস্থা আর বাজেট ছাড়া ভোট দেওয়া যাবে না। সংবিধানের পরিবর্তন তো সংসদ করবে। আগামী নির্বাচনে যে সংসদ গঠিত হবে, তারা করবে। ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিলে তখন সংসদ সদস্যদের এর বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধা থাকবে না। এটা পাস করতে যখন সংসদে তোলা হবে, তখন যদি সংসদ সদস্যরা বলেন, এটা আমার কাছে পছন্দ না, এটা দেশের জন্য ভালো হবে না। তখন বাস্তবায়ন করবে কী করে? কাজেই এসব আলোচনা অর্থহীন।
অতীতের উদাহরণ টেনে দেশবরেণ্য এই আইনজীবী বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ আর প্রাদেশিক পরিষদ মিলে আওয়ামী লীগের ৪৪০ জন সদস্য বিজয়ী হয়েছিলেন। তাদের নিয়ে গণপরিষদ করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৪৪০ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪০ জন সদস্য আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে বলেছিলেন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ এবং তারা পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার জন্য স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সে সময় নির্বাচিত সদস্যদের শতকরা ১০ ভাগ মুক্তিযুদ্ধকালে দল ত্যাগ করেছিলেন। এখন ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিলে কোনো একটি দল তিন দিন রাখতে পারবেন? যদি কোনো দল আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬০, ২৭০টিতে জিতে সংসদে যায় তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিতে পারবে।
ড. শাহদীন মালিক আরও বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যাবে না। আলোচনা করা যাবে না, সে কথা তো বলা নেই। কাজেই সমালোচনা করাতে বাধা ছিল না। কেউ কখনো করেনি। বর্তমান সংবিধানেই রাষ্ট্রপতির অনেক ক্ষমতা আছে। যদি রাষ্ট্রপতি সেটার ব্যবহার না করেন, তাহলে সংবিধানের দোষ দিয়ে লাভ কী? বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী আর প্রধান বিচারপতির নিয়োগ দেওয়া ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু না। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আছে। সংসদে কোনো আইন পাস হলে সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে যায় সম্মতির জন্য। রাষ্ট্রপতি সম্মতি না দিয়ে সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন। দ্বিতীয়বার যদি সংসদ ওটা পাস করে তাহলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিতে বাধ্য। কিন্তু ৫৫ বছরে রাষ্ট্রপতি কয়টা বিল ফেরত পাঠিয়েছেন? কাজেই ক্ষমতা নাই কে বলেছে? ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে, কোনো বিষয় মন্ত্রিপরিষদের আলোচনার জন্য পাঠাবেন, তিনি সেটা পারেন। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, মন্ত্রিসভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, তিনি সেটা পাঠাতে পারেন বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী। বাস্তবতা হলো, ৫০-৫৫ বছরে একজন রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার কাছে কোনো প্রস্তাব পাঠাননি। এগুলো না জেনে না বুঝে অনেক আলোচনা হচ্ছে। ধরুন, অনাস্থা প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রী হেরে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী যদি রাষ্ট্রপতিকে বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দেন। রাষ্ট্রপতি ওটা মানতে বাধ্য নন। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য তবে তাকে তিনি নিয়োগ করতে পারবেন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এক আলোচনা সভায় বলেছেন, এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রচেষ্টার মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাহী বিভাগকে যত বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অতীতে একজন স্বৈরাচার হয়েছিল। এ জন্য নির্বাহী বিভাগকে আমরা বিলুপ্ত করতে পারব না, দুর্বল করতে পারব না।
এদিকে ঐকমত্য কমিশনের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, যেহেতু আমি সংবিধান নিয়েই কাজ করি, সংবিধানের আলোকেই বলব। যে ঐকমত্য কমিশনের কথা বলা হচ্ছে, এ ঐকমত্য কমিশনের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এটা হচ্ছে কয়েকজন লোক এবং কয়েকটা রাজনৈতিক দল বসে সংলাপ করছে, আমরা এই-এই করব। এটা কখনই এনফোর্স করা যাবে না। কারণ এটা তো আইন না। এটা হলো সালিশি সিদ্ধান্ত। ঐকমত্য কমিশন যে আলাপ-আলোচনাই করুক, এগুলোর আইনগত ভিত্তি তেমন একটা নেই। তবে হ্যাঁ, রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনা করে যেটা ঠিক করে, রাজনৈতিক দল যদি সেটাকে তাদের একটা বাধ্যবাধকতা মনে করে, তাহলে তাদের সেভাবে একটা আইন সংশোধন করতে হবে। তখন এটার একটা গুরুত্ব থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে যে, আমরা যে আলোচনা করলাম, সবার সঙ্গে কথা দিলাম, এটার একটা কিছু করতে হবে। এটা আইন করা উচিত। এ ধরনের বাধ্যবাধকতা যদি তারা অনুভব করেন, তখনই সেটা একটা আইন হবে। আইনে পরিণত না হলে বলতে পারবে না, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দশ বছর। যতক্ষণ পর্যন্ত এটি আইনে পরিণত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা একটা আলোচনা ও সালিশি সিদ্ধান্ত। এসবের আইনগত ভিত্তি নেই।
বিজ্ঞ এই আইনজীবী বলেন, আমাদের ইতিহাস আছে। এর আগেও ‘৯০-তে আন্দোলন করতে গিয়ে ৫ দল, ১৪ দল আলোচনা করে তৈরি করেছিল কী কী করতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় গেল তখন তারা সেটা করল না। এখনকার ঐকমত্য কমিশনের চাইতে তখনকারটা বেশি কার্যকর ছিল। কারণ এখন যে কমিশন করা হয়েছে সেখানে বাইরে থেকে একজনকে এনে বসানো হয়েছে যেটা মানসিকভাবে কেউ গ্রহণ করেনি। যারা যাচ্ছে তারা কেউ গ্রহণ করেনি। কিন্তু সরকার যেহেতু করছে এবং বিশেষ প্রক্রিয়ায় দেশ আছে, একটা সাংবিধানিক সংকট আছে, সবকিছু মিলে এগুলো করছে। ৯০ সালের আন্দোলনের সময় লিয়াজোঁ কমিটি ছিল। তখন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু সেটা থাকেনি। কারণ ওটার আইনগত ভিত্তি নাই। এটা আলোচনা। এখানেও তা-ই হবে। এখন এখানে যাই করুক, যারা ক্ষমতায় যাবে, তারা যদি করে তাহলে এটার মূল্য আছে, না করলে এটার কোনো মূল্যই নেই।
বিএনপি ছাড় দেওয়ার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কী ভাবছে? জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপি শর্ত সাপেক্ষে রাজি হয়েছে। আরও আলাপ করতে হবে। আশা করি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছা যাবে। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাআলোচনা আছে। আমরা আশাবাদী, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে।