Image description

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত আদম বাড়াইপাড়া গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া মামুন ইসলামকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতেও সংগ্রাম করতে হয়েছিল। এরপর জীবিকার সন্ধানে রাজধানীতে পাড়ি জমান তিনি।

একটি গার্মেন্টে কাজ শুরু করেন। দ্রুতই বুঝতে পারেন এই সামান্য আয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। একসময় বন্ধু মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে একটি ছোট গার্মেন্ট কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সুন্দরভাবে এগোচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এলোমেলো হয়ে যায় সব। পুলিশের গুলিতে থেমে যায় তার জীবনসংগ্রাম।

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর মিরপুরে আয়োজিত বিজয় মিছিলে যোগ দেন মামুন। সেখানেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। এখন স্বামীকে হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছেন শারমিন আক্তার লতা।

মামুন ছিলেন তার বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বাবা আজগর আলী রাজধানীর একটি পাইপ ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। প্রায় এক দশক ধরে পুরান ঢাকার একটি মেসে থাকেন। আর মা তসলিমা বেগম গৃহিণী। বর্তমানে আদম বাড়াইপাড়ায় থাকেন। বৃদ্ধ এই দম্পতি উপার্জনক্ষম বড় ছেলেকে হারিয়ে বর্তমানে অসহায় জীবনযাপন করছে।

মামুনের ছোট ভাই সবুজ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই ভাইয়া প্রতিটি মিছিলে অংশ নিতেন। ৫ আগস্ট তিনি মিরপুরে বিজয় মিছিলে যোগ দেন। ওই সময় মিরপুর-১ গোলচত্বরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়ে। একই সময় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও মিছিলে হামলা চালায়। এক পর্যায়ে দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশের ছোড়া একটি গুলি ভাইয়ার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুকের বাম পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। এরপর শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে মিরপুর-১০ এলাকার আলোক হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে ভাইয়ার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমি এবং তার বন্ধু রাসেল দ্রুত হাসপাতালে ছুটে যাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি আমরা। তবে পুলিশের গুলির মুখে আমরা আটকে যাই। অ্যাম্বুলেন্স লক্ষ করেও গুলি ছুড়ছিল পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। কোনো উপায় না দেখে পরবর্তীতে তাকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে সাড়ে ৪টায় মারা যান তিনি। পরে ৬ আগস্ট তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি আদম বাড়াইপাড়ায় নিয়ে এসে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

শহীদ মামুনের স্ত্রী লতা আমার দেশকে জানান, আন্দোলনের সময় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলা এবং হত্যা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। ২১ জুলাই অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণের ফলে তাকে রংপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাননি। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে তিনি মৃত কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।

লতা বলেন, আমি আমার সন্তান ও স্বামীকে হারিয়ে সবকিছু হারিয়েছি। আমি ন্যায়বিচার চাই। সংসারের হাল ধরতে সরকারের কাছে একটি সরকারি চাকরির দাবি জানাই।

মামুনের বাবা আজগর আলী শোকার্ত ভাষায় বলেন, ছেলের মরদেহ গ্রামে পৌঁছানোর পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এখন আর কোনো কাজ করতে পারেন না।

মা তসলিমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি। আমার স্বামীও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি আর কাজ করতে পারেন না। ছেলেকে হারিয়ে আমরা এখন কীভাবে চলব জানি না। আমাদের পরিবার এখন চরম সংকটে রয়েছে।

এখন পর্যন্ত আর্থিক সহযোগিতা হিসেবে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ, জামায়াতে ইসলামী থেকে ২ লাখ, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ এবং ইউএনও থেকে ১০ হাজার টাকা পেয়েছে বলে জানায় মামুনের পরিবার।