Image description

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার মতো নিষ্পত্তি হওয়া স্পর্শকাতর ইস্যুকে আবার সামনে এনে মিথ্যা এবং বানোয়াট বয়ান তৈরি করে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলতে তৎপর হয়েছে দিল্লি।

১০ ট্রাক মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পাওয়া ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে জড়িয়ে দ্য ইন্ডিয়া টুডে এবং নর্থ ইস্ট নিউজ সম্প্রতি দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই দুটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক এই জেনারেল ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য চলতি মাসের ৬ থেকে ১৭ জুন চীন সফর করেছেন।

জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার গত মঙ্গলবার আমার দেশ-এর সঙ্গে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি জেল থেকে মুক্তির পর দেশের বাইরে যাননি। এটি নিশ্চিতভাবেই ভারতের নতুন ষড়যন্ত্র। আর এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এ ধরনের মিথ্যা এবং বানোয়াট সংবাদ করিয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। সুবির ভৌমিক এবং চন্দন নন্দী নামের যে দুজন সাংবাদিক এই প্রতিবেদন লিখেছেন, তারা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। জেনারেল হায়দার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহবান জানান। আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপকালে সাবেক এই গোয়েন্দা প্রধান ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা, এ ব্যাপারে করা মামলা, তাকে এ মামলায় জড়ানোর ঘটনা এবং কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

গত ১৯ জুন চন্দন নন্দী নর্থ ইস্ট নিউজে এবং গত ২০ জুন সুবীর ভৌমিক দ্য ইন্ডিয়া টুডেতে জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর গোপন চীন সফর শিরোনামে পরপর দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দুটি প্রতিবেদনেরই ভাষা এবং বিষয়বস্তু কার্যত অভিন্ন।

সেখানে দাবি করা হয়েছে যে, উলফা প্রধান পরেশ বড়ুয়া এখন চীনে আছেন এবং জেনারেল (অব.) হায়দারের কথিত চীন সফরের সময় বাংলাদেশের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তাও দেশটিতে গিয়েছিলেন। এই কাহিনিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে ভুয়া ফ্লাইট নম্বরও দিয়েছেন সুবির ভৌমিক।

প্রতিবেদনে জেনারেল হায়দারকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দাবি করে বলা হয়েছে, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা থেকে তাকে মুক্ত করে দেওয়ার ফলে ভারতের নিরাপত্তা বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে ভারতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অপারেশন সিন্দুরের পর পাকিস্তান এদের দিয়ে ভারতে আক্রমণ চালাতে পারে বলে প্রতিবেদক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ভারতীয় পত্রিকার এই প্রতিবেদন এবং প্রতিবেদনে কথিত চীন সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, রিপোর্ট দুটি নিশ্চিতভাবেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর দেওয়া মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। আমার চীন সফর সম্পর্কে রিপোর্টে যা বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট। আমি এটাকে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছি। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ‘আমি ১৮ জুন চীন থেকে ঢাকায় ফিরেছি। আর ১৯ এবং ২০ জুন দুটি গণমাধ্যমে এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হলো। এই মিথ্যা রিপোর্ট আগে থেকে তৈরি ছিল। আমি জানুয়ারিতে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেশের বাইরে কোথাও যাইনি।’

আপনি দেশের বাইরে যাননি। তাহলে এ ধরনের মিথ্যা রিপোর্টের কারণ কী, তা জানতে চাইলে জেনারেল হায়দার বলেন, “দেখুন উচ্চ আদালত আমার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ না পেয়ে আমাকে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালাস দিয়েছে। কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা না থাকায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকেও খালাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বলা হয়েছে, ড. ইউনূসের সরকার আমাদের মুক্ত করে দিয়েছে। এটা স্পষ্ট, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্ল্যান অনুযায়ী আমাকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছিল। বিচারের নামে যে প্রহসনের মাধ্যমে আমাকে সাজা দেওয়া হয়েছিল সেটার দেখভালও করেছিল ‘র’। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সবকিছু সাজিয়েছিল তাদের মতো করে। অভিযোগ গঠন থেকে শুরু করে রায় পর্যন্তÑসবই তারা তত্ত্বাবধায়ন করেছে। বিচারের সময়ে ‘র’-এর লোকজন আদালতে উপস্থিত থাকত। তিনি আরো বলেন, এ সময় প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার আমাকে নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট করতে থাকে। সবই ছিল ভারতের গেম প্ল্যানের অংশ।”

শেখ হাসিনার পতনের পর তারা এখন আবার নতুন করে মাঠে নেমেছে। ১০ ট্রাক অস্ত্রের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে ড. ইউনূস সরকারকে ভারত চাপে ফেলতে চায়। হাসিনার পতন, তার বিচার কোনো কিছুই মেনে নিতে পারছে না দেশটি।

কীভাবে এবং কী অভিযোগে তাকে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় জড়ানো হলো, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে জেনারেল হায়দার আমার দেশকে বলেন, এই মামলা করা হয় বিএনপি সরকারের আমলে। বিএনপি সরকারের সময়েই মামলার চার্জ গঠন হয়ে বিচারকাজ শুরু হয়। ১/১১ সরকারের সময় ভারত এখানে হস্তক্ষেপ শুরু করে। জেনারেল মঈন এবং জেনারেল মাসুদ ভারতের নির্দেশনা অনুযায়ী সবকিছু করতে থাকেন। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। একই বছর ১৫ মে আমাকে আটক করে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ক্ষেত্রে আমি তথ্য দিয়ে সহায়তা করিনি।

এই অভিযোগকে হাস্যকর আখ্যা দিয়ে জেনারেল হায়দার আমার দেশকে বলেন, ১০ ট্রাক অস্ত্র যখন আটক হয়, তখন আমি ডিজিএফআইতে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিআইবি) পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। সিআইবির কাজ হলো প্রতিপক্ষ গোয়েন্দাগুলোর দিকে নজর রাখা। প্রতিপক্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরনের সাবোটাজ করে থাকে। যেমনÑ ধরুন গোলাবারুদের ডিপোতে আগুন ধরিয়ে দিল অথবা অস্ত্রাগারে নাশকতা করল। আমার কাজ ছিল সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সদস্য এ ধরনের কোনো কাজে যুক্ত হচ্ছেন কি না অথবা প্রতিপক্ষ কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন কি নাÑসেগুলোর ওপর নজর রাখা এবং সে ব্যাপারে ডিজিকে রিপোর্ট করা। এর বাইরে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সিআইবির কোনো কাজ নেই। অর্থাৎ আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হলো, তা সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন।

ভারত কেন আপনাকে এভাবে টার্গেট করল, এমন প্রশ্নের জবাবে জেনারেল হায়দার বলেন, এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমি ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে এনএসআইয়ের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। আর ওই সময় বিএনপি তথা চারদলীয় জোট সরকার উৎখাতে ভারত একের পর এক পরিকল্পনা করতে থাকে। এখানে ব্যাপক আর্থিক বিনিয়োগও ছিল। ভারত চাইছিল যে কোনো মূল্যে সরকার ফেলে দেবে। আবদুল জলিলের (আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক) ট্রাম্পকার্ডের কথা তো সবার মনে থাকার কথা। সরকার উৎখাতে ওটা ছিল ভারতীয় প্রকল্প। এখানে দুটি অংশ ছিল। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা তখন হঠাৎ করে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে তিন দিনের একটি কর্মী-সমাবেশ ডাকে। সেখানে দেড় লাখ কর্মী হাজির করার কথা ছিল। অন্যদিকে ওই সমাবেশের তৃতীয় দিনে মহাখালীতে যুবলীগ একটি সমাবেশ ডাকে। পরিকল্পনা ছিল তৃতীয় দিনে প্রশিকার সমাবেশে বোমা হামলা করে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটানো হবে। আর ওই সুযোগে যুবলীগ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর দখল করে সরকার উৎখাত করবে। দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বিএনপির অন্তত ১০০ জন এমপিকে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা দেওয়া হবে। প্রত্যেক এমপিকে ৫ কোটি করে টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কয়েকজন এমপিকে টাকা দেওয়াও হয়েছিল। সরকার উৎখাতে এটা ছিল ভারতের হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। আমার কারণে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় ভারতের সরকার উৎখাতের সেদিনের পরিকল্পনা।

জেএমবিও তৈরি করেছে ভারত। তারা যে ডেটোনেটর ব্যবহার করত, তা ছিল ভারতের তৈরি। সেগুলোতে ভারতের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির সিল পর্যন্ত ছিল। হাজার হাজার ডেটোনেটর মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলাদেশে এনেছিল জেএমবির জন্য। তাদের পরিকল্পনা ছিল থার্টিফার্স্ট নাইটে অন্তত তিন হাজার মানুষকে হত্যা করবে। আতাউর রহমান সানিকে আটকের মাধ্যমে আমি সেই পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিই। আমি তখন এখানে ‘র’-এর স্টেশন চিফের কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। তারা কোনো জবাব দিতে পারেনি। বিষয়টা তখন আমেরিকাকেও জানানো হয়েছিল।

ভারতের বাংলাদেশবিরোধী এই অপতৎপরতার ব্যাপারে জেনারেল হায়দার সরকারকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের আহবান জানিয়ে বলেন, এটা নিশ্চিতভাবে উদ্বেগের বিষয়। আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া একটি ইস্যু নিয়ে যেভাবে নতুন করে অপপ্রচারে নেমেছে ভারত তা এক বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের অংশ। বিগত হাসিনা আমলের ১৫ বছর ভারত যেভাবে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করেছে তারা আবার নানাভাবে বাংলাদেশকে চাপে ফেলে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার তাদেরকে টার্গেট করছে ভারত। এ ব্যাপারে সবারই সতর্ক থাকা উচিত।