
প্রশাসনে বর্তমান সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৫তম ব্যাচ গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি বড় ব্যাচ হিসেবে পরিচিত। এই ব্যাচে মোট কর্মকর্তা আছেন ৭৮ জন। তারমধ্যে ৮ জন সচিব, ৬৮ জন অতিরিক্ত সচিব এবং ২ জন যুগ্মসচিব। ৮ জন সচিবের মধ্যে ২ জনকে সচিব করা হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে। বাকি ৬ জন সচিব হয়েছেন এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে। অবাক করার মতো ঘটনা হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যে ৬ কর্মকর্তা সচিব হয়েছেন তাদের সবাই আওয়ামী লীগ আমলের অতিরিক্ত সচিব। আক্ষরিক অর্থে এরা কেউই বঞ্চিত নন।
অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আমলে যেসব কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছেন এবং চরমভাবে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের কেউই অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়ে সচিব হতে পারেননি। প্রশাসন ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের বঞ্চিত এবং চরমভাবে বঞ্চিত মোট কর্মকর্তা ছিলেন ২০ জন। তারমধ্যে ৯ জন ছিলেন যারা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলের ১৬ বছরে একটিও পদোন্নতি পাননি, সিনিয়র সহকারী পদে থেকেছেন। এদেরকে চরমভাবে বঞ্চিত বলে ধরা হয়ে থাকে। ৮ জন ছিলেন যারা আওয়ামী ১৬ বছরে একটিমাত্র পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব পর্যন্ত উঠতে পেরেছেন। আর ৩ জন যুগ্মসচিব পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান আমলে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণকে ভয়াবহ অন্যায় বা অনাচার বলে আখ্যায়িত করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সচিব হওয়া ৬ জন কর্মকর্তার মধ্যে চরম আওয়ামী ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাও রয়েছেন, যারা হাসিনার লুটপাট ও ফ্যাসিজম কায়েমে সরাসরি ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে ১৫তম ব্যাচের সর্বশেষ যে দু’জনকে সচিব করা হয়েছে মফিদুর রহমান এবং জাহেদা পারভীন- এরা দুজনই আওয়ামী ফ্যাসিস্ট হিসেবে পরিচিত। শেখ মুজিবের মাজার জিয়ারত, জন্ম শত বার্ষিকী পালনসহ আওয়ামী রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে এরা ওই সময় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি শেখ মুজিবের জন্ম শত বার্ষিকী উপলক্ষে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিশেষ নিবন্ধও প্রকাশ করেছেন। যেসব লেখায় আওয়ামী রাজনীতিকেও অনেকাংশে হার মানায়। আর এদেরই সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে।
এই সময়ের আরো বড় অবাক করার ঘটনা হলো, ১৫তম ব্যাচের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সচিব পদে পদোন্নতি না দিয়ে পরবর্তী অর্থাৎ ১৭তম ব্যাচ থেকে সচিব করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরামর্শে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। যাকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বঞ্চিতদের আবারো বঞ্চিত এবং ‘নতুন ফ্যাসিজম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন কেউ কেউ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এ রকমের আচরণ জুলাই অভ্যূত্থান ও আত্মত্যাগের সঙ্গে চরম বেঈমানী ও বিশ^াসঘাতকতা। আওয়ামী লীগের অনিয়ম ও বৈষম্য নিরসনের স্লোগানে তৈরি হয়েছিল জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট। কিন্তু সেই বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সরকারের আমলে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবার নতুন করে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যা কেউই আশা করেননি। জাহেদা পারভীনকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সংস্কার ও সমন্বয়) সচিব করা হয়। তার এই পদোন্নতিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচনা চলতে থাকাকালেই পরের মাসে মফিদুর রহমানকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত হয় এসএসবিতে। এ খবর ফাঁস হলে ব্যাপক হইচই হয় জনপ্রশাসনে কর্মকর্তাদের মধ্যে। তারমধ্যেই ১০ এপ্রিল মফিদুর রহমানকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে ফুঁসে উঠে প্রশাসন। বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতিসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। এ আন্দোলনের ফলে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের প্রক্রিয়া কিছুটা থামে। গত ১৯ জুন ৫ সচিব এবং একজন গ্রেড-১ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যাদের চাকরিচ্যূতির দাবিতে বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন চলছিল মফিদুর রহমান এবং জাহেদা পারভীনসহ সেই আসল ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তারা এখনো বহাল-তবিয়তেই রয়েছেন। উল্লেখ্য. আওয়ামী সুবিধাভোগী ও ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করে বর্তমানে কর্মরত ৪৪ সচিবকে চাকরিচ্যুতির দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী সংগঠনটি।
জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি ব্যাচের ৭৬ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে মাত্র ৮ জন কর্মকর্তাকে সচিব করার পর এত কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে পরবর্তী ব্যাচের সচিব পদে পদোন্নতির নজির অতীতে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলেও নেই। তাও যে ৮ জনকে সচিব করা হয়েছে তাদের কেউই আক্ষরিক অর্থে আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত নন। আওয়ামী লীগ আমলে চরমভাবে বঞ্চিত হয়েছেন অর্থাৎ একটিও পদোন্নতি পাননি যে ৯ জন কর্মকর্তা তাদের সবাইকে সচিব না করে পরবর্তী ব্যাচ থেকে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করাটা ভয়াবহ রকমের অন্যায়। এই কর্মকর্তারা আওয়ামী ১৬ বছরে পদোন্নতি তো পানই-নি, পদায়নেও চরম বৈষম্য ও হয়রানি-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এছাড়া সামাজিক নিপীড়ন তো ছিলই। বিগত ১৬ বছর ধরে এরা পরিবর্তনের আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। সেই পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তাদের প্রাপ্য অধিকার পূরণ হচ্ছে না। অন্যদিকে, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যারা নিজেদেরকে আওয়ামী লীগ ‘ট্যাগ’ লাগানোর জন্য নানা অনিয়ম-অপকর্মের পাশাপাশি শেখ হাসিনা ও মুজিব ‘বন্দনা’ প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন। সরকারি কর্মকর্তার পরিবর্তে নিজেদেরকে ‘সাবেক ছাত্রলীগ’ পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের বন্দনায় ছিলেন পঞ্চমুখ। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য নানা কায়দায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। সেই শেখ হাসিনার দোসররাই এখন পরিবর্তনের ফলভোগ করছেন।
সূত্রমতে, বর্তমান সময়ের এসব অপকর্মের সঙ্গে প্রশাসনের শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ এবং বাইরেরও প্রভাবশালী মহল জড়িত রয়েছেন। শুধু এখনকার এটিই নয়, এই অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই জনপ্রশাসনে পদোন্নতি-পদায়নে ভয়াবহ অনিয়ম-অপকর্ম চলে আসছে। সবচেয়ে বেশি তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছিল ডিসি পদায়ন নিয়ে। ‘নতুন বন্দোবস্ত’র অন্তরালে যারা এসব অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অদূর ভবিষ্যতে তাদেরকে বড় রকমের জবাবদিহি করতে হতে পারে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও এরজন্য সরাসরি প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে ভবিষ্যতে যে কোনো সময়। জুলাই অভ্যুত্থানে শত শত ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন এমন ‘বন্দোবস্ত’ পাওয়ার জন্য নয়, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
শীর্ষনিউজ