
মাঠ প্রশাসনে একের পর এক কেলেঙ্কারিতে জড়াচ্ছেন কর্মকর্তারা। তাদের অনৈতিক আচরণ কিংবা নারীঘটিত কেলেঙ্কারি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি গণমাধ্যমেও প্রায়ই সংবাদ দেখা যায়। এবার দুই নারীর সঙ্গে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিনের আপত্তিকর দুটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাকে গতকাল শনিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে বদলি করা হয়েছে। তার এ ঘটনায় কর্মকর্তাদের বেপরোয়া আচরণ ও নীতিনৈতিকতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসন বিশ্লেষকরা।
পরিসংখ্যান বলছে, এক যুগে আটজন ডিসি যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও এসব অভিযোগ কম নয়। কিন্তু এসব ঘটনায় নজির সৃষ্টি হওয়ার মতো শাস্তি দেয়নি সরকার। নানা কায়দা-কৌশলে পার পেয়ে যান অপরাধী কর্মকর্তারা। ফলে অপরাধ-অনাচার বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন আরও বাড়ছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সচিবালয় সূত্র জানায়, প্রশাসনে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বহুবার এমন অভিযোগে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ওএসডি হয়েছেন। তবে বিভাগীয় মামলায় তারা যে খুব বেশি শাস্তি পেয়েছেন, এমন কোনো রেকর্ড নেই।
একজন সাবেক সচিব ও প্রশাসন বিশ্লেষক কালবেলাকে বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে বড় বড় কর্মকর্তা অনিয়ম-অনৈতিকতা করে পার পেয়ে গিয়েছিলেন। বর্তমান প্রশাসনও সেদিকে হাঁটলে কর্মকর্তারা শুধরাবে না। প্রশাসন সংস্কার হবে না। সুতরাং প্রশাসন ঠিক করতে হলে এসব কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করতে হবে। কিন্তু এসব শাস্তি আমরা দেখতে পাব বলে মনে হচ্ছে না।
জনপ্রশাসনের সূত্রানুযায়ী, ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন ডিসি মনোজ কান্তি বড়াল স্থানীয় এক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার একটি বাড়িতে প্রায় চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল মনোজকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে অসামাজিক কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে তিনি গিয়েছিলেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে। সেই মনোজ কান্তি বড়ালের বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তৎকালীন আওয়ামী প্রশাসন তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করার পর পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করে।
২০১৯ সালে জামালপুরের তৎকালীন ডিসি আহমেদ কবীরের সঙ্গে তারই অফিসের এক নারী অফিস সহায়কের আপত্তিকর দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটি কেলেঙ্কারির প্রমাণ পেলেও তাকে শুধু বেতন গ্রেড কমিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য তিনি আর চাকরি জীবনে পদোন্নতি পাবেন না বলেও শাস্তির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।
জামালপুরের পর ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর দিনাজপুরের ডিসি মাহমুদুল আলমের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়ানোর অভিযোগ ওঠে। এক ভিডিও বার্তায় ডিসির সঙ্গে নিজের অনৈতিক সম্পর্কের তথ্য ফাঁস করেন এক নারী। তার সেই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ডিসিকে খারাপ চরিত্রের মানুষ উল্লেখ করে তার প্রত্যাহার দাবি করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সুশীল সমাজের লোকজন। পরে তাকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অবশ্য নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন ডিসি মাহমুদুল আলম। জুনিয়র নারী সহকর্মীকে মেসেঞ্জারে অশোভন আচর ও খারাপ প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠলে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর নাটোরের তৎকালীন ডিসি গোলামুর রহমানকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন। পরে তাকে বড় কোনো শাস্তি না দিয়ে একটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক করা হয়।
এ ছাড়া ২০২০ সালে নেত্রকোনার ডিসি মঈনউল ইসলামের বিরুদ্ধে তার কার্যালয়ের এক নারী কর্মীর সঙ্গে অনৈতিকতার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠার পর তাকে প্রত্যাহারের জন্য মানববন্ধনও করেন এলাকাবাসী। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তদন্ত চলাকালেই তাকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া অভিযোগকারী ওই নারীকেও বদলি করা হয়।
অন্যের স্ত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১৭ মে বাগেরহাটের তৎকালীন ডিসি এ এন এম ফয়জুল হককে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। যোগদানের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে প্রত্যাহার হন তিনি। পরে তাকে আর কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি। বরং সময়মতো তিনি পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিবও হয়েছিলেন।
এক নারীর সঙ্গে সাবেক ডিসি হাবিবুর রহমানের ‘ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের’ তিনটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
একজন নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর বরগুনার সাবেক ডিসি হাবিবুর রহমানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। ভিডিও ফাঁসের ঘটনায় ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান ভুক্তভোগী নারী। কিন্তু নোটিশের কোনো জবাব দেননি হাবিবুর।
ভুক্তভোগীর আইনজীবী মহিউদ্দীন বলেছিলেন, বিয়ের কথা বলে ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন সাবেক ডিসি হাবিবুর রহমান। কিন্তু পরে তিনি বিয়ে করতে রাজি হননি। ফলে আমরা লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি কোনো জবাব দেননি। এ কারণে আমরা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেব।
জানা যায়, ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাবিবুর রহমান বরগুনার ডিসি হিসেবে যোগদান করেন। আড়াই বছর পর ২০২৩ সালের ৯ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে উপসচিব পদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখায় পদায়ন করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর তিনি পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে শরীয়তপুরের ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে দুই নারীর আপত্তির ছবি ছড়িয়েছে। এক নারী বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। ঘটনার পর তাকে গতকাল শনিবার ওএসডি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
কর্মকর্তারা বলেন, প্রশাসনে এমন ঘটনা নতুন নয়। দিন দিন এসব অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে। ঘটনা জানাজানি হলে অভিযুক্তদের কেবল ওএসডি করা হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে কী শাস্তি হয়, সেটি আর জানা যায় না। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অনাকাক্ষিত এসব ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।