Image description

ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় আন্তর্জাতিক দৃষ্টি এখন ঘুরে গেছে হরমুজ প্রণালীর দিকে। বিশেষ করে এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িত হওয়ার ফলে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে এখন। ওমান ও ইরানের মধ্যে ৩৩ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি সংকীর্ণ পানিপথ হলো হরমুজ প্রণালী। এর মাধ্যমে প্রতিদিন বিশ্বের মোট তেলের এক-পঞ্চমাংশ বিভিন্ন দেশে যায়। এ খবর দিয়ে অনলাইন আরব নিউজ বলছে, এই কৌশলগত পানিপথটি এখনো খোলা থাকলেও, বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সংঘাত আরও বেড়ে গেলে ইরান যদি অবরোধ আরোপ করে বা জাহাজে হামলা চালায়, তবে এই গুরুত্বপূর্ণ নৌ-পথ হুমকির মুখে পড়বে। ১৩ই জুন ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা শুরু করার পর এই সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানী, সামরিক কর্মকর্তা ও শহরগুলো লক্ষ্য করে চলমান হামলায় কয়েক শত মানুষ নিহত হয়েছে। সর্বশেষ এতে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এই সমুদ্রপথ অবরোধের হুমকির মধ্যেই বিশ্ব জ্বালানি বাজার চরম উদ্বেগে রয়েছে। এই রুটে সামান্য বিঘ্ন হলেই তেলের দাম আকাশচুম্বী করে তুলতে পারে, অর্থনীতি অস্থিতিশীল করতে পারে এবং নতুন জ্বালানি সংকট তৈরি করতে পারে। 

 

সৌদি আরবে ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক সালমান আল-আনসারি বলেন, হরমুজ প্রণালী শুধু একটি জলপথ নয়— এটি বৈশ্বিক জ্বালানির ধমনী। একে অবরোধ করা হলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এমন এক প্রতিক্রিয়া শুরু হবে, যার জন্য কেউ প্রস্তুত নয়।  মার্কিন জ্বালানি বিষয়ক প্রশাসন জানায়, বিশ্বের মোট ব্যবহারের ২০ শতাংশ অর্থাৎ প্রতিদিন ২ কোটি ব্যারেল তেল এই প্রণালীর মধ্য দিয়ে পাড়ি দেয়। সাথে এক-পঞ্চমাংশ প্রাকৃতিক তরল গ্যাস, যা মূলত কাতার থেকে আসে। এই রুট এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এর বিকল্প প্রায় নেই। উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ তেল সরাসরি অন্য পথে পাঠানো যায় না, আর এটি একমাত্র গভীর পানির রুট যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল ট্যাংকার চলতে পারে। এই তেলের শতকরা ৮৪ ভাগ যায় এশিয়ায়। 

এর প্রধান ক্রেতা চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। ২০১৯ সালের এক বিশ্লেষণে সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি বলেছিল, হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়া ৭৬ শতাংশ তেলই এশিয়ার বাজারে যায়। ইরান-ইসরাইল সংঘাতে উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম একদিনে ৬৯ ডলার থেকে ৭৪ ডলারে পৌঁছে যায়। যদিও তখনও কোনো জাহাজ চলাচলে বাধা পড়েনি। লেবাননের অর্থনীতিবিদ জাসেম আজাকা বলেন, শুধু আশঙ্কাই বাজারকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়, তেলের দাম এক লাফে ২৫ ডলার বেড়ে ১০০ ডলারের ওপরে চলে যাবে। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য অস্বাভাবিক অবস্থা। আজাকা বলেন, তেলের দাম বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। কারণ শতকরা ৯৫ ভাগ পণ্যের উৎপাদনেই তেলের ভূমিকা আছে। কাঁচামাল উত্তোলন, খাদ্যপ্রস্তুতিসহ সব ক্ষেত্রেই।  আল-আনসারি আরও বলেন, ইরান যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে, তা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট তৈরি করবে, মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়াবে, আর দুর্বল অর্থনীতিগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেবে।


সৌদি আরব প্রতি বছর ৫.৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল হরমুজ দিয়ে রপ্তানি করে। এই তেল মোট প্রবাহের শতকরা ৩৮ ভাগ। যদিও তাদের ইস্ট-ওয়েস্ট পাইপলাইন রয়েছে, যার ধারণক্ষমতা ৭ মিলিয়ন ব্যারেল। কিন্তু এটি ইতিমধ্যে হুতি হামলার কারণে প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় আছে।  আরব আমিরাতের ফুজাইরাহ পাইপলাইনেরও একই অবস্থা। ১.৮ মিলিয়ন ব্যারেল ক্ষমতা হলেও ইতিমধ্যে তা পুরোপুরি ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরানের নিজস্ব গোরেহ-জাস্ক পাইপলাইন কেবল ৭০ হাজার ব্যারেল সরবরাহ করতে পেরেছে এবং ২০২৪ সালের শেষ দিকে বন্ধ হয়ে গেছে। যদি প্রণালী বন্ধ হয়, সৌদি আরব ও আমিরাত মাত্র ২.৬ মিলিয়ন ব্যারেল বিকল্প রুটের মাধ্যমে সরবরাহ দিতে পারবে — যা মোট ২০ মিলিয়নের তুলনায় নগণ্য। আজাকা বলেন, উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতি তেল নির্ভর হওয়ায় দীর্ঘ সময় প্রণালী বন্ধ থাকলে তাদের বাজেটে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আল-আনসারি বলেন, এই প্রণালী এক-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক তেলের রুট। একে বন্ধ করা মানে এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্থবিরতা। চীন তাদের অর্ধেক তেল এই রুট দিয়ে নেয়। ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াও চরম বিপদে পড়বে। জরুরি রিজার্ভ ব্যবহার করতে হতে পারে। বিকল্প রুটে খরচ দ্বিগুণ হবে। এতে এই প্রথম চীন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর বিশ্বের আরও অনেক অর্থনীতি এতে আক্রান্ত হলে বিশ্ব মন্দা আসার আশঙ্কা থাকবে।