
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিবন্ধন পেতে বেড়েছে আগ্রহী নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) পর্যন্ত নিবন্ধন পেতে সংস্থাটির নিবন্ধন বিভাগে শতাধিক দলের আবেদন জমা পড়েছে। এ ছাড়া নিবন্ধনের সময় পুনরায় বাড়ানোর জন্যও আবেদন করেছে বেশকিছু দল। এদিকে দল নিবন্ধনের জন্য ইসির বর্ধিত সময় শেষ হচ্ছে আজ রবিবার। গতকাল শনিবার নবগঠিত বেশকিছু দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেষদিনে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপিসহ বেশকিছু দল তাদের আবেদনপত্র জমা দেবে।
খবরের কাগজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর গেল ১০ মাসে গঠিত হয়েছে অন্তত ৩০টি দল। এর মধ্যে প্রায় দুই মাস আগে আত্মপ্রকাশ করা দলও এবার আবেদনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এত কম সময়ে কীভাবে নিবন্ধনের সব শর্ত পূরণ করা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবেদনকারী দলগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের মধ্যে মাত্র ২-৩ শতাংশ দলের নিবন্ধনের শর্ত পূরণের যোগ্যতা রয়েছে। বাকি ৯৭ শতাংশ দলের বেশির ভাগই নামসর্বস্ব। অনেক দলের কার্যালয়ের ঠিকানা, এমনকি ফোন নম্বর পর্যন্ত ভুয়া।
আবেদনকারী অনেক দলের নেতা-কর্মী তো দূরের কথা, বেশির ভাগেরই নেই কার্যালয়। ইসিতে দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ দলের কোনো অস্তিত্বই নেই। কমিশনে উল্লিখিত ঠিকানায় রয়েছে হয় অন্য লোকের অফিস অথবা মানুষের বসতবাড়ি। এসব দলের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা ও পেশাজীবী। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি ছাড়া বেশির ভাগ দলের অস্তিত্ব শুধু কাগজে-কলমে।
ইসিতে আবেদন করা দলগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক দল, নিউক্লিয়াস পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, আমজনতার দল, জনতার দল, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ, দেশ জনতা পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি, জনতা পার্টি, সর্বজন বিপ্লবী দল, তৃণমূল জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় ভূমিহীন আন্দোলনসহ শতাধিক নতুন রাজনৈতিক দল।
এদিকে নিবন্ধন আবেদনের শেষদিন আজ রবিবার ইসিতে আবেদন জমা দিতে যাবে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপিসহ অন্তত ১৫টি রাজনৈতিক দল। এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, ইসির শর্ত অনুযায়ী তারা এনসিপির অফিস সেটআপ ও কমিটি গঠনসহ দলের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। এ ছাড়া ডেসটিনি গ্রুপের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আমীনের নেতৃত্বে গত ১৭ এপ্রিল গঠিত বাংলাদেশ আ-আমজনতা পার্টি থেকে নাম পাল্টে বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টি হওয়া দল এবং মাত্র ২ মাস আগে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন এবং বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে ২৫ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করা জনতার পার্টি বাংলাদেশও রয়েছে আবেদনের প্রস্তুতি নেওয়া দলগুলোর সারিতে। এসব দলের নেতারা জানিয়েছেন, নিবন্ধন পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণের যাবতীয় প্রস্তুতি তারা নিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘নতুন দলের জন্ম ইতিবাচক হলেও তা যদি নামসর্বস্ব ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা বা আলোচনায় আসার জন্য গঠিত হয় তা গণতান্ত্রিক চর্চার সুফল বয়ে আনবে না। এসব দল দেশ ও জনগণের কোনো কাজেও আসবে না। কারণ তাদের অনেকেরই উদ্দেশ্য ভোটের আগে বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা বা আসন ভাগাভাগি করে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করা।’
নিবন্ধনের শর্ত ও নিয়মাবলী
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলের ইসির নিবন্ধন পেতে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর অফিস, অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন (মহানগর) থানায় কার্যালয় এবং প্রতিটি কার্যালয়ে ন্যূনতম ২০০ ভোটার তালিকাভুক্ত থাকতে হবে। এর বাইরে নিবন্ধনের জন্য দলের গঠনতন্ত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিধান রয়েছে। যেমন- কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা, সব পর্যায়ের কমিটিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ সদস্যপদ নারীদের জন্য নির্ধারিত রাখা এবং পর্যায়ক্রমে ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা শ্রমিক ও অন্য কোনো পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন না থাকা ইত্যাদি।
নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে বিদ্যমান আইন-বিধি অনুযায়ী ১০টি তথ্য আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। নিবন্ধন ফি হিসেবে দিতে হবে ৫ হাজার টাকা, যা অফেরতযোগ্য। দলীয় প্যাডে দরখাস্তের সঙ্গে দলের গঠনতন্ত্র, নির্বাচনি ইশতেহার (যদি থাকে), দলের বিধিমালা (যদি থাকে), দলের লোগো ও দলীয় পতাকার ছবি, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যের নামের তালিকা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সর্বশেষ স্থিতি, তহবিলের উৎস, দল নিবন্ধনের আবেদনকারীর ক্ষমতাপত্র, নিবন্ধন ফি বাবদ অফেরতযোগ্য ট্রেজারি চালানের কপি এবং নিবন্ধনের তিনটি শর্তের মধ্যে যেকোনো একটি পূরণের প্রমাণ জমা দিতে হবে।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, নিবন্ধনের জন্য জমা পড়া আবেদনগুলো যাচাই-বাছাইয়ে ইসির একটি কমিটি রয়েছে। নিবন্ধনের আগে আমরা দেখব, আবেদনকারী শর্ত পূরণ করেছে কিনা। আইনে উল্লিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে না পারা কোনো দলকেই নিবন্ধন দেওয়া হবে না। সেই লক্ষ্যে আবেদনকারী দলগেুলোর অফিস ও ঠিকানা, সাংগঠনিক কার্যক্রম খুঁজে বের করা এবং নথি-সংবলিত সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে মাঠে কাজ করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
অন্তর্বর্তী সরকারের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ডিসেম্বরে ভোটের লক্ষ্য ধরে নতুন রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দিতে গত ১০ মার্চ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে ইসি। সে সময় ইসিতে আবেদন করে ৬৫টি নতুন রাজনৈতিক দল। এরপর এনসিপিসহ বেশকছিু দলের আবেদনের প্রেক্ষিতে দলের নিবন্ধন আবেদনের সময়সীমা ২০ এপ্রিল থেকে বাড়িয়ে আজ ২২ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫০টি। সম্প্রতি আদালতের আদেশে ইসির নিবন্ধন স্থগিত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আর নিবন্ধন ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশ জাময়াতে ইসলামী। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইসি থেকে নিবন্ধন পেয়েছে ৬টি দল। এ গুলো হচ্ছে- এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি), নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজিপি) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
এর আগে গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ইসিতে ৯৩টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন পায় মাত্র দুটি দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)। নিবন্ধন পায়নি ৮৭টি দল। এবারের নির্বাচনের আগে ওইসব দলও তাদের আবেদন পুনর্মূল্যায়ন করতে ইসিকে অনুরোধ জানিয়েছে।