
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নেতাদের সরকারকে দেওয়া ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হচ্ছে রবিবার (২২ জুন)। এ সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে এ দিন থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে সচিবালয়ের অভ্যন্তরীণ কর্মপরিবেশ বিশেষ করে বাজেট পাসের দিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সব বিভাগের কর্মপরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট মহল। তারা বলছেন, এভাবে চলতে পারে না। দীঘদিন ধরে চলমান এই সংকটের অবসান প্রয়োজন। সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর খোদ সচিবালয়ের কর্মপরিবেশে দীর্ঘদিন ধরেই অচলাবস্থা বিদ্যমান। সচিবালয়ে কর্মপরিবেশ ফিরবে কবে?
গত বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) সকালে টানা পঞ্চম দিনের মতো আন্দোলন চলাকালীন সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচি ঘোষণা করেন তারা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধনে অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ জন্য তারা আন্দোলনে নামেন। কর্মচারীদের আন্দোলনের মধ্যেই ২৫ মে রাতে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, চার ধরনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা যাবে।
আন্দোলনরত কর্মচারীরা এই অধ্যাদেশকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান। তাদের ভাষ্য, অধ্যাদেশটি জারির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকা আইন অনুযায়ী কোনও কর্মচারীর অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে অন্তত ৭-৮টি ধাপ পার করতে হয়। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার আগে বিভিন্ন তদবিরে শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সর্বশেষ ঈদের ছুটির আগে ৩ জুন পর্যন্ত সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেন কর্মচারীরা। চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সরকারের ৭ উপদেষ্টাকে স্মারকলিপিও দিয়েছেন তারা। ১৫ জুনের মধ্যে চাকরি অধ্যাদেশ বাতিল না করলে ১৬ জুন থেকে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার হুমকিও দিয়েছিলেন কর্মচারী নেতারা।
জানা গেছে, অধ্যাদেশটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছে। সংগঠনটির মতে, বহুল আলোচিত সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ জারির মধ্য দিয়ে বিভাগীয় মামলার পরিবর্তে শুধু একটি লেটার দিয়ে সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত বা দণ্ড দেওয়ার বিধান এখন কার্যকর। এর ফলে কিছু স্বার্থবাদী কর্মকর্তার কাছে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত দাসে পরিণত হবেন, ক্ষমতার অপব্যবহার বেশি হবে, বিভিন্ন কারণে অপছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে নাজেহাল হবেন, চাকরি হারানোর সুযোগ তৈরি হবে, অপছন্দ হলে কর্মকর্তার রোষানলে পড়বেন, একজন অভিযোগকারী কর্মকর্তা নিজেই তদন্তকারী ও বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, ভয়ভীতির কারণে সরকারি কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হবে।
তাই ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিল করতে হবে- এই দাবিতে চলমান আন্দোলন স্থগিত রেখে ১০ দিনের জন্য ঈদের ছুটিতে গিয়েছিলেন সরকারি কর্মচারীরা। ১৪ জুন ছুটি শেষে ১৫ তারিখ অফিস খোলার পর একদিন সময় দিয়ে ১৬ জুন থেকে দাবি আদায়ে আবারও আন্দোলন শুরু করেন তারা। তখন থেকেই সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়সহ সব সরকারি অফিসে কর্মপরিবেশ, শৃঙ্খলা, চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখা, সবশেষে নাগরিক সেবা দেওয়া অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সৃত্র জানিয়েছে, রবিবার অর্থ মন্ত্রণালয় ব্লকেডের মতো কঠিন কর্মসূচি দেওয়ায় সচিবালয়ের অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলাসহ কর্মপরিবেশ অনেকাংশেই হুমকির মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশ সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা আগেই বলেছিলেন, দাবি না মানলে দীর্ঘ কর্মবিরতিতে যাবেন তারা। এ কর্মসূচিতে দেশের অন্য সব সরকারি অফিসের কর্মচারীদেরও সম্পৃক্ত করা হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে সরকারের স্বাভাবিক কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হবে। বাধাগ্রস্ত হবে সব ধরনের নাগরিক সেবা। প্রশাসনের শৃঙ্খলার অবনতি হবে। ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড। অর্থ মন্ত্রণালয় ব্লকেড কর্মসূচি এরই পূর্ব প্রস্তুতি বলে মনে করছেন অনেকে। যদি তাই হয়, তাহলে সরকারের প্রশাসন বলতে কোনও কিছুই থাকবে না বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
উল্লেখ্য, ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে গত ২৪ মে থেকে আন্দোলন করছেন সচিবালয়ের কর্মচারীরা। চার ধরনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা যাবে- এমন বিধান রেখে গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন হয়। এরপর ২৫ মে অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারি এবং পরবর্তীতে কর্মচারীদের দীর্ঘ কর্মবিরতিতে যাওয়ার আগাম ঘোষণা সরকার তথা প্রশাসনকে এক অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সুচিন্তিত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ হাসানের সই করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্য নিতে পারবে। গঠিত কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব।
এ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়েছে কিছু ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকা কখনও প্রত্যাশিত ব্যাপার হতে পারে না। ভালো করে শোনা ও বোঝার জন্যই কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রয়োজনে অধ্যাদেশটি সংশোধন করা হবে।’
তার এই বক্তব্যের পর কর্মচারী নেতারা জানান, এই কালো আইনের কোনও সংশোধন তারা মানবেন না। পুরো অথ্যাদেশটি বাতিল করতে হবে। কর্মচারী নেতাদের এমন কঠিন অবস্থানের মধ্য দিয়ে সরকার এক ধরনের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
জানা গেছে, সরকারি কর্মচারীরা অধ্যাদেশটিকে নিবর্তনমূলক ও কালো আইন হিসেবে অবহিত করছেন। এটি বাতিল করার জন্য সচিবালয়ে বিক্ষোভ মিছিল, কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি ছাড়াও কয়েকজন উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা।
কর্মচারীদের স্মারকলিপি পাওয়ার পর গত ৩ জুন আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই অধ্যাদেশের ব্যাপারে তাদের (কর্মচারীদের) অনেক আপত্তি আছে। তাদের আপত্তিগুলো শোনার পূর্ণ মানসিকতা সরকারের রয়েছে। এ বিষয়ে উপদেষ্টা পর্যায়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির দায়িত্ব হবে আপত্তিগুলো ভালো করে শোনা, বিবেচনা ও সুপারিশ করার। কমিটি প্রস্তাব দেবে। অধ্যাদেশটি যেহেতু উপদেষ্টা পরিষদে পাস হয়েছে, তাই কমিটির সুপারিশও উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপিত হবে।’
এর আগে গত ১ জুন অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন কর্মচারীরা। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অধ্যাদেশটি দেখেছি। উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজনের নজরে বিষয়টি এনেছি। এখানে কিছু প্রভিশন আছে, যেগুলো অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা আছে।’
আলোচিত অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারীদের (আইনানুযায়ী সব সরকারি চাকরিজীবী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী) চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো- সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনও কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা অন্য যেকোনও সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অন্য যেকোনও কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যেকোনও সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।
এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে।
অধ্যাদেশে বলা হয়, অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। যদিও আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম নেতা নুরুল ইসলামের মতে, নারী সহকর্মীদের ভীত সন্ত্রস্ত পরিবেশে কাজ করতে হবে, কেউ কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণেও চাকরিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, এমনকি কেউ কেউ ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের কারণেও কর্মকর্তার রোষানলে পড়তে পারেন, দেশ ও জাতির সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মচারীদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে, কর্মচারীদের ন্যায্যতা-প্রাপ্যতার দাবিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দারুণভাবে বাধার সৃষ্টি করবে, ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের দাবি না মানা হলে অফিস চালুর পর বড় পরিসরে আন্দোলনে যাবো। বড় ধরনের কর্মবিরতি পালন করবো এবং সেই কর্মসূচিতে সারা দেশের সব অফিসের কর্মচারীদের সম্পৃক্ত করা হবে।’