Image description

কোনো দেশের স্বৈরাচার বা দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার যখন জনগণের উপকারের কথা মাথায় না রেখে দুর্নীতি ও লুটপাটের উদ্দেশ্যে বিদেশী ঋণ নেয় তা-ই ‘অডিয়াস ডেট’ বা ‘বিতর্কিত বিদেশী ঋণ’ হিসেবে পরিচিত। এ ঋণ নেয়া হয় স্বৈরাচার বা দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের অনিয়ম, দুনীতি ও লুটপাটের স্বার্থে। ‘অডিয়াস বা বিতর্কিত বিদেশী ঋণের’ তাত্ত্বিক ধারণা অনুসারে, কোনো সরকার যদি জনকল্যাণের বাইরে নিজের ক্ষমতা, দমন নীতি, দুর্নীতি ও লুটপাটের উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়, তবে তার বোঝা জনগণের ওপর চাপানো ন্যায়সংগত নয়। আন্তর্জাতিক আইন এখনো এ ধরনের ঋণকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় না, তবে একে ‘অডিয়াস ডেট’ বিবেচনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মওকুফ বা ঋণ পুনর্গঠনের উদাহরণ রয়েছে।

গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। পতিত স্বৈরাচার সরকারের শাসনামলে এমন অনেক মেগা প্রজেক্ট নেয়া হয়েছিল যেগুলো দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে উল্টো বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে। কর্ণফুলী টানেল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প যার অন্যতম উদাহরণ। ক্ষমতায় আসার পর পর রাশিয়ার ঋণে নেয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর ঋণ চুক্তি পর্যালোচনার বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চ মহলে আলোচনা চলছিল। তবে এতে সংশ্লিষ্ট দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের একধরনের টানাপড়েন দেখা দিতে পারে—এমন আশঙ্কা করা হয়। এরপর এসব প্রকল্পে ঋণ চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ মহল অনেকটা নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। বিদেশী ঋণদাতাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিও নেই।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনেও মেগা প্রকল্পগুলো থেকে দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয় উঠে আসে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রো রেল, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দেশের সাতটি মেগা প্রকল্পের কোনো কোনোটির ব্যয় প্রায় ৯০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের সাত মেগা প্রকল্পে শুরুতে যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, চূড়ান্তভাবে তার চেয়ে ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে। অর্থাৎ এসব প্রকল্পের উদ্দেশে নেয়া ঋণের বড় একটি অংশই লোপাট করা হয়েছে।

শ্বেতপত্র কমিটি-প্রধান ও সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে শুধু মেগা প্রকল্প থেকেই লুটপাট হয়েছে তা নয়, সব খাত থেকেই লুটপাট হয়েছে। মেগা প্রকল্পের লুটপাটের ব্যয় এ সরকারকে বহন করতে হচ্ছে, এক্ষেত্রে সবার আগে মধ্যমেয়াদি মূল্যায়ন করা দরকার। বিষয়টি আমরা শ্বেতপত্রে তুলে ধরেছি। আমাদের বার্ষিক কত বিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধে ব্যয় করতে হয় এবং কত ডলার আমাদের সক্ষমতা রয়েছে সেটিও বিবেচনা করতে হবে। শুধু যে বিগত সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে তা নয়, বর্তমান সরকার বাজেটের জন্যও বিদেশী ঋণ নিয়েছে। সেটিও আগের ঋণের সঙ্গে যুক্ত হবে। মধ্যমেয়াদি মূল্যায়নের মাধ্যমে এটির সমাধান করতে হবে।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত বা স্বৈরাচার সরকারের নেয়া ঋণকে ‘অডিয়াস ডেট’ বিবেচনা করে মওকুফ বা ঋণ পুনর্গঠনের উদাহরণ রয়েছে। ২০০৮ সালে ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া ঘোষণা দেন যে তাদের দেশের বৈদেশিক ঋণের একটি বড় অংশ জনবিরোধী ছিল। তিনি প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিল করে তা কম দামে পুনঃক্রয় করেন। একইভাবে ইরাকেও সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে নেয়া প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার ঋণকে যুক্তরাষ্ট্র ও প্যারিস ক্লাবের নেতৃত্বে ‘অনৈতিক’ বিবেচনায় প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মওকুফ করা হয় ২০০৩ সালের পর। কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাতিস্তা সরকারের সব বিদেশী ঋণকে ‘অডিয়াস’ হিসেবে ঘোষণা করে। পশ্চিমা শক্তি একে গ্রহণ না করলেও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় কিউবা এ ঋণ উপেক্ষা করে।

২০১৬ সালে মোজাম্বিকের গোপনে নেয়া প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণ জনসমক্ষে আসে। এ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একপ্রকার অডিয়াস ডেট স্ক্যান্ডাল বলেই দেখে। ঋণদাতারা পরে কিছু ঋণ পুনর্গঠন করে। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ স্বৈরশাসন, হাইতির দুভালিয়ে পরিবারের একই ধরনের ঋণের নজির রয়েছে। এ মুহূর্তে এমন ঋণ নিয়ে বিতর্ক চলছে লেবানন, গ্রিস, জাম্বিয়া, শ্রীলংকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে। মাহিন্দা রাজাপাকসের শাসনামলে চীনের কাছ থেকে নেয়া বিপুল ঋণকেও অনেকে ‘অডিয়াস’ বলে অভিহিত করেন। হাম্বানটোটা বন্দর ও ম্যাটালা বিমানবন্দরের মতো বিতর্কিত মেগা প্রকল্পে এসব ঋণ ব্যয় হয়। এসব প্রকল্প কখনই লাভজনক হয়নি, বরং ঋণ পরিশোধে শ্রীলংকার বৈদেশিক রিজার্ভ নিঃশেষ হয়ে যায়। স্থানীয় বিশ্লেষকরা এ ঋণকে অডিয়াস বললেও আন্তর্জাতিকভাবে এখনো তা স্বীকৃতি পায়নি। শ্রীলংকা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এসব ঋণকে অডিয়াস না বললেও দাতাদের সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠন চুক্তি সম্পন্ন করেছে।

বাংলাদেশ সরকারের ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর তথা ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণ স্থিতি ছিল ৮ লাখ ৭৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে ঋণের এ স্থিতি ১৯ লাখ ২২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সে হিসাবে এ পাঁচ বছরে সরকারের ঋণ বাড়ে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪৭ বছরে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, মাত্র পাঁচ বছরে তার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে পতিত শেখ হাসিনা সরকার। সরকারি এ ঋণের মধ্যে ৯ লাখ ৪০ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। বাকি ৯ লাখ ৮১ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা এসেছে বিদেশী উৎস থেকে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় দেশের ঘাড়ে প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকা ঋণের বোঝা চাপিয়ে গিয়েছেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়নের কথা বলে লুটপাটের উদ্দেশে বাছবিচারহীন প্রকল্পে অর্থের অপব্যবহারের কারণেই সরকারের ঋণ এতটা স্ফীত হয়েছে। এসব ঋণের বেশকিছু অংশ অডিয়াস ডেট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মেগা প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে। যেগুলোয় অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে এনেছে শ্বেতপত্র কমিটি। তাদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে এক প্রকার স্বীকার করা হয়েছে যে দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে যে ফলোআপ করা দরকার ছিল সেগুলো হয়নি। রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়, জনসমর্থন নেই এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে তার দায় কেন জনগণ মেটাবে। বিশ্বের বহু দেশে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বিদেশী ঋণে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। উপযোগিতা না থাকার কারণে এ রকম অডিয়াস ডেট নামে পরিচিত ঋণসংক্রান্ত বিষয় থেকে বেরিয়ে আসার পদ্ধতিও এখন চর্চা হচ্ছে। সরকার কেন সেদিকে যাচ্ছে না? এসব দুর্নীতি-অনিয়ম খতিয়ে দেখার বিষয়ে আমরা সরকারের কোনো আগ্রহ দেখছি না।’

১৬ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা সরকারের শ্বেতহস্তী প্রকল্পগুলোর অন্যতম কর্ণফুলী টানেল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকার চীনা ঋণ ২ শতাংশ সুদসহ আগামী ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। টানেলের নির্মাণ ব্যয় তুলে আনাসহ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ তুলে আনার একমাত্র মাধ্যম যানবাহন থেকে আদায় হওয়া টোল। টানেলটি ২০২৩ সালের অক্টোবরে চালু হয়। এটি দিয়ে যানবাহন চলাচলের যে সম্ভাবনার কথা শোনানো হয়েছিল, তা এখন ‘গালগল্পে’ পরিণত হয়েছে। টানেল থেকে টোল বাবদ আয় করা অর্থ দিয়ে ঋণ শোধ দূরের কথা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচই উঠছে না। শুধু কর্ণফুলী টানেল নয়, বিগত সময়ের বেশির ভাগ প্রকল্পেই এমন ফরমায়েশি পূর্বাভাস বা প্রাক্কলন করা হয়েছে মূলত প্রকল্পগুলোকে বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে দেখানোর জন্য।

পটুয়াখালীর পায়রাকে সমুদ্রের ‘অন্যতম প্রবেশদ্বার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। বলা হয়েছিল, পায়রাকে দেশের লজিস্টিক হাব হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এজন্য সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পায়রায় সমুদ্র বা নদীবন্দর নয়; বরং একটি ঘাট হতে পারত। বিপুল বিনিয়োগ ও ব্যয়ের পর এখন প্রকল্পটি থেকে সরে আসাও যাচ্ছে না। এ কারণে পায়রা বন্দর প্রকল্পকে অর্থনীতির জন্য বিষফোড়া বলে মন্তব্য করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে পায়রা নদীর রাবনাবাদ চ্যানেলের গভীরতা বাড়াতে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর বেশির ভাগই নির্বাহ হয়েছে রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠিত বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল (বিআইডিএফ) থেকে নেয়া ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) ডলারের মাধ্যমে। খননের মাধ্যমে গত বছরের মার্চের মধ্যেই গভীরতা সাড়ে ১০ মিটারে উন্নীত করা হয়। কিন্তু এরপর প্রকল্পের খনন কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার আগেই পলি পড়ে ভরাট হতে থাকে রাবনাবাদ চ্যানেলের তলদেশ। বর্তমানে এ চ্যানেল দিয়ে বড় জাহাজ চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দেশে ডলার সংকটের মধ্যেও চ্যানেলটি খননে বিআইডিএফের মাধ্যমে রিজার্ভ থেকে দেয়া ৫০ কোটি ডলারের পুরোটাই অপচয় হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এবং নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে শুরুতেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে আপত্তি তোলেন দেশের পরিবেশবাদীরা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে উচ্চ সুদে রাশিয়ার কাছ থেকে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে। বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় আওয়ামী সরকারের সময়ে বড় আকারে সমালোচনা ছিল। এমনকি এ প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ ঋণের বড় একটি অংশ আত্মসাৎ করা হয়েছে এমন অভিযোগ বারবার উঠেছে। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের তিরুনেলভেলি জেলায় নির্মাণ করা হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ‘কুদানকুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট’। ২০২২ সালের শুরুতে এ দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ও উৎপাদনসংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখিয়েছেন বাংলাদেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক। আন্তর্জাতিক জার্নাল স্প্রিঙ্গারে এ বিশ্লেষণ ‘এস্টিমেটিং দি ইকোনমিক কস্ট অব সিটিং আপ আ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট অ্যাট রূপপুর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উঠে আসে।

দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রেরই নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এক। যদিও বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় উৎপাদন ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ দশমিক ৩৬ সেন্ট করে, যেখানে কুদানকুলামে নির্মাণাধীন তৃতীয় ও চতুর্থ ইউনিটের ক্ষেত্রে তা প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ দশমিক ৩৬ সেন্ট করে। সে হিসেবে রূপপুরে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে কুদানকুলামের চেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদকাল ও গড় উৎপাদন হিসাব করে ইউনিটপ্রতি এ উৎপাদন ব্যয় (লেভেলাইজড কস্ট অব এনার্জি বা এলসিওই) বের করা হয়েছে।

দেশের বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে জাপানের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। এ প্রকল্পের সঙ্গে সংযুক্ত মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে মোট ৫৭ হাজার কোটি টাকা। তবে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার কাছ থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া সমুদ্রবন্দরের কোনো কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি পরিদর্শনে যান বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পটি পরিদর্শনে গিয়ে তিনি জানান, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পটি একটি ‘প্রকল্পবিলাস’। এ প্রকল্পে সাধারণ মানুষ খুব বেশি উপকৃত হচ্ছে না বলে সে সময় মন্তব্য করেন তিনি। ব্যয়বহুল এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সেখানকার স্থানীয় মানুষের বড় আকারে কোনো উপকার হচ্ছে না। বরং প্রকল্প বাস্তবায়ন করে একটি সিন্ডিকেট লাভবান হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শেখ হাসিনা সরকারের নেয়া সাতটি মেগা প্রকল্পের কী প্রয়োজনীয়তা ছিল এবং প্রকল্পগুলো যৌক্তিকভাবে নেয়া হয়েছে কিনা, এসব বিষয় পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। প্রকল্পগুলোর ব্যয় পর্যালোচনার কাজ করছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। পর্যালোচনা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বেশকিছু প্রকল্পের ব্যয় কমানোও হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া মেগা প্রকল্প ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের আর্থিক ব্যয় কমিয়ে আনা এবং যেসব প্রকল্পে বিদেশী বড় ঋণ রয়েছে সেসব ঋণের বিষয়ে বিশ্লেষণ করে দাতাদের সঙ্গে পরামর্শ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারের শীর্ষ মহল।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অপ্রয়োজনীয় ও জনস্বার্থ বাধাগ্রস্ত হয় এমন প্রকল্প থেকে সরে এসেছে সরকার। এমনকি অনেক প্রকল্পের ব্যয়ও সংশোধন করা হয়েছে। মেগা প্রকল্পের বিষয়গুলো নিয়ে সরকার শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন পেয়েছে। সেই প্রতিবেদনে যেসব চিত্র উঠে এসেছে সেগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ হচ্ছে। এগুলোর আর্থিক দিকগুলো ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে কোনো প্রকল্প হঠাৎ করে বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এর বাইরে সরকার অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রকৌশলীদের দেশের উন্নয়ন অবকাঠামোয় যুক্ত করছে। তাদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শও নেয়া হচ্ছে।’

তবে শেখ হাসিনা সরকারের সময় নেয়া ঋণনির্ভর প্রকল্প বন্ধ করার সুযোগ নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার যে প্রকল্পগুলো চলমান রেখেছে সেগুলো তারা পছন্দ করে চলমান রেখেছে—বিষয়টি এমন নয়। চালু রাখতে হয়েছে কারণ সেগুলো বন্ধ করাটা দেশের জন্য কস্ট ইফেক্টিভ হবে না। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পে যেসব ঋণ নেয়া হয়েছে, সেগুলোয় লুটপাট হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে অডিয়াস ডেটের পক্ষে যদি প্রমাণ থাকে তাহলে সরকারের উচিত দাতাদের সঙ্গে দরকষাকষির একটা উদ্যোগ নেয়া।’