
উত্তরবঙ্গের জেলা নীলফামারি জুড়ে ভয়ঙ্কর এক প্রতারক চক্র গড়ে উঠেছে। যারা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডাসহ উন্নত দেশে পাঠানোর নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। চক্রের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থানাতেই শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে আইনের ফাঁক গলিয়ে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চ্যানেল 24 এর অনুসন্ধানে এই চক্রের বিস্তারিত উঠে এসেছে। স্থানীয় প্রশাসন প্রতারণার বিষয়টি অবগত থাকলেও পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের যোগসাজশের কারণে চক্রের সদস্যরা বরাবর-ই নিরাপদ থেকে যাচ্ছে।
অনুসন্ধান বলছে, বাংলাদেশে জন্ম নেয়া অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ব্লগার বনি আমিনসহ অন্য অনেক ব্লগারের ভিডিও কনটেন্টের মূল কণ্ঠ গোপন করে চক্রটি সেখানে নতুন কণ্ঠ লাগিয়ে ভিনদেশে পাঠানোর প্রস্তাবসহ ভিডিও কনটেন্ট সোস্যাল মিডিয়ায় ছাড়ে। সেখানে নিজেদের মোবাইল নম্বরজুড়ে দিয়ে বলা হয়, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশে যেতে চাইলে ওই নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য। ভিডিও কনটেন্ট দেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিনদেশে যেতে ইচ্ছুক সহজ-সরল মানুষ যোগাযোগ করলেই ফাঁদে আটকে পড়েন।
বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত অনেকেই ভিডিওতে দেয়া মোবাইল নম্বর ধরে যোগাযোগ করেন। প্রতারক চক্রটি প্রথম দফায় দশ হাজার টাকা নিয়ে আবেদন করতে বলে। এরপর পর্যায়ক্রমে নানাভাবে কারো কাছ থেকে দশ লাখ আবারও কারো কাছ থেকে পনের লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। একপর্যায়ে মোবাইল নম্বর বন্ধ করে দেয় চক্রটি। যশোর জেলার বাসিন্দা আবুল হোসেন অনুসন্ধান টিমকে জানিয়েছেন, চক্রের কাছে টাকা খুইয়ে তিনি নীলফামারির কিশোরগঞ্জ জেলায় একটি প্রতারণার মামলা করেছেন। পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তিনি আইনি প্রতিকার পাননি। তিনি ছেলে আর মেয়ের জামাইকে অস্ট্রেলিয়া পাঠাতে ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন শরীফুল আলমকে। যার বাড়ি দিনাজপুরের রাণীরবন্দর এলাকায়। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায় আরও ভয়ঙ্কর এক তথ্য। অর্থাৎ শরীফুলের ব্যাংক একাউন্টে টাকা পাঠালেও এটি তিনি পরিচালনা করেননা। পরিচালনা করেন রোকনুজ্জামান রিপন নামে আরেকজন। যিনি ইসলামি ব্যাংকের স্থানীয় এজেন্ট ব্যাংক পরিচালনা করেন। অনেক খোঁজাখুজির পর রিপনকেও পাওয়া গেল। তিনি ঘটনায় অনুতপ্ত। তবে কমিশনের টাকা রেখে বাকি টাকা নীলপামারির কিশোরগঞ্জ জেলার নিতাই ইউনিয়নের সেলিমের কাছে পৌছে দেয়ার দাবি করেন তিনি। তার দেয়া তথ্য ধরে সেলিমের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে অনুসন্ধানী টিম। কিন্তু সেলিম পলাতক।
জানা যায়, সেলিম এরই মধ্যে আলিশান বাড়ি করেছেন। বেশ কয়েকবার পুলিশ অভিযান চালালেও তাকে ধরতে পারেনি। অনুসন্ধান বলছে, এই চক্র শুধু ব্যাংক একাউন্ট ব্যবহার করেই টাকা নেয়নি। চক্রটি রকেট, বিকাশ এবং নগদেও টাকা গ্রহণ করেছে। সেই টাকায় প্রতারক চক্রের সদস্যদের একেকজন আলিশান বাড়ি, গাড়ি, মোটরসাইকেল এবং আমোদফূর্তি করছে। বৈধ আয়ের কোনো উৎস্য না থাকলেও গ্রামের খেটে খাওয়া বেকার তরুণদের এভাবে বদলে যাওয়া দেখে স্থানীয় অনেকে হতবাক হয়েছেন। তবে ভয়ে দু’ একজন মুখ খুললেও নিরাপত্তার ভয়ে অনেকেই কথা বলতে চাননি। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ থানা এলাকার নিতাই ইউনিয়ন ও আশপাশের প্রায় প্রতিটি বাড়ির কেউ না কেউ এই চক্রে জড়িত। স্থানীয়দের কাছে এই প্রতারণা ভিসা খেলা নামে পরিচিত।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় জেলা পুলিশ সুপার এ এফ এম তারিক হোসেন খানের সাথে। জাল ভিসার কারিগরদের সাথে কিছু পুলিশ কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকার কথা স্বীকার করে তিনি জানিয়েছেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামানও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, দ্রুতই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।