
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে আপাতত বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে কোনো প্রভাব না পড়লেও যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যুদ্ধ যদি দ্রুত না থামে এবং দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে শতভাগই আমদানিনির্ভর।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহে আপাতত প্রভাব পড়েনি। আমরা আশা করছি, হয়তো এ যুদ্ধ দ্রুতই থেমে যাবে। তবে যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে চললে জ্বালানি তেল সরবরাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং দাম বাড়তে পারে। সব কিছুই নির্ভর করবে এ যুদ্ধ কত দ্রুত থামে সেটার ওপর।
এদিকে পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা আপাতত ঠিক আছে। তবে যুদ্ধের কারণে দাম বেড়ে গেলে স্পট মার্কেট থেকে কেনা এলএনজির দাম বেড়ে যেতে পারে, যা আর্থিক ক্ষতি করবে। একই সঙ্গে যদি জাহাজ চলাচলে কোনো বিঘœ ঘটে এবং নিয়মিত এলএনজি আমদানিতে বাধা তৈরি হয়, তবে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে বাংলাদেশ। আমাদের এলএনজি সরবরাহ এক ঘণ্টার জন্য বন্ধ থকলেও গ্যাসের সংকট তীব্র হয়।
এদিকে গত মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম আপাতত বাড়ানো হবে না। সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে ক্রয় এবং অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন,
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ সরকার পর্যবেক্ষণ করছে। জ্বালানি তেলের দামের বিষয়ে আরও অপেক্ষা করব। এখন পর্যন্ত আমদানিতে যুদ্ধের প্রভাব পড়েনি। চলমান বাজারদরেই সব আমদানি করা হচ্ছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। জ্বালানি ছাড়াও অন্য অনেক পণ্যে এর প্রভাব পড়বে।
যুদ্ধের কারণে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় এখনই কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ জন্য এলএনজি ও সার আমদানির কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। আপাতত আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আপাতত আমাদের বাণিজ্য ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। জ্বালানি মন্ত্রণালয় বিকল্প চিন্তা অবশ্যই করছে। যেহেতু আমরা এলএনজির ওপর নির্ভর করি বেশি। যুদ্ধে শুধু জ্বালানি না, সার ও জাহাজ চলাচলেও প্রভাব পড়বে। হরমুজ প্রণালী দিয়ে জাহাজ আসে, সেখানে প্রভাব পড়তে পারে।
প্রসঙ্গত, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতের ফলে জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ এই অঞ্চল থেকে আসা সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। যুদ্ধ শুরুর পর অপরিশোধিত তেলের দাম ৭ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৪.২৩ ডলারে লেনদেন হয়েছে। তবে ২০২২ সালের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর বেড়ে যাওয়া দামের তুলনায় এটি এখনও নিচে; ওই সময় অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারেরও উপরে উঠেছিল। এদিকে গত শুক্রবার এশিয়া ও ইউরোপজুড়ে শেয়ারের দাম কমেছে। জাপানের নিক্কেই শেয়ার সূচক ০.৯ শতাংশ কমেছে।
চরম পরিস্থিতিতে ইরান যদি হরমুজ প্রণালীতে অবকাঠামো বা জাহাজ চলাচলের ওপর টার্গেট করে, তাহলে প্রতিদিন লাখ লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। এই প্রণালী দিয়ে বিশ^ব্যাপী তেলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ সরবরাহ হয়ে থাকে।
বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের প্রভাবে বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। সামনে আরও বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে জাহাজে তেল পরিবহনের খরচ বাড়তে শুরু করেছে। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে তেলের দাম অনেক বেড়ে যাবে।
বিপিসি বলছে, পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশ ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ৩০ শতাংশ পরিবহন করা হয় হরমুজ প্রণালী দিয়ে। এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে কী করে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যায়, সেটা নিয়ে ভাবছে সরকার।
দেশে দুই ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত। তবে একমাত্র জ্বালানি শোধনাগারের সক্ষমতা অনুযায়ী বছরে ১৫ লাখ টনের বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানির সুযোগ নেই। অপরিশোধিত হিসেবে সৌদি আরব থেকে অ্যারাবিয়ান লাইট ও আরব আমিরাত থেকে মারবান লাইট আমদানি করে বিপিসি। সাধারণত দুই মাস আগের গড় দাম ধরে বিল হিসাব করা হয়। অর্থাৎ, জুনে সরবরাহ করা তেলের দাম নির্ধারিত হয় মার্চের গড় দাম ধরে। তাই এখনও দামে প্রভাব পড়েনি। বিপিসি সূত্র বলছে, দুই দেশ থেকেই অপরিশোধিত তেল আসে হরমুজ প্রণালী হয়ে।
বাংলাদেশ বেশি আমদানি করে ডিজেল, ফার্নেস, অকটেন, জেট ফুয়েলের মতো পরিশোধিত জ্বালানি তেল। এগুলোর কোনোটাই মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে না। আসে মূলত সিঙ্গাপুর ও এর আশপাশের কয়েকটি দেশ থেকে। বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি। এর মধ্যে ৪৬ লাখ টন ডিজেল। দেশের একমাত্র শোধনাগারটি থেকে পাওয়া যায় ৬ লাখ টন ডিজেল, বাকিটা আমদানি করতে হয়।