Image description
৭৩৬ কর্মকর্তার জন্য ব্যয় ১৮শ কোটি

অর্থনৈতিক সংকটের মুখে সরকার যখন কৃচ্ছ্র ও বাজেট সংকোচনের পথে হাঁটছে, ঠিক তখনই রাজধানীর বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিলে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বিপুল ব্যয়ে হতে যাচ্ছে আটটি বহুতল ভবন। মাত্র ৭৩৬ জন কর্মকর্তার আবাসনের জন্য প্রতিটি ২৫ তলার এসব ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। বিলাসবহুল এ প্রকল্পে রয়েছে মাল্টিপারপাস ভবন, সুসজ্জিত পুকুর, অ্যাম্পিথিয়েটার, খেলার মাঠ, মার্বেল পাথরের সিঁড়ি ও লবি, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ও সেফটি ক্যানোপির মতো বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। এমনকি প্রকল্পের নকশা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা নিতে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয়ে রয়েছে কর্মকর্তাদের ‘বিদেশ সফর’ও।

সরকারের দাবি, এটি আবাসন সংকট নিরসনের উদ্যোগ। তবে বিশ্লেষকদের মতে, প্রকল্পের অনেক ব্যয় অস্বাভাবিক এবং এতে সরকারের কৃচ্ছ্র নীতির বাস্তবতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। তারা বলছেন, সরকারি জমিতে শুধু আবাসনের অবকাঠামো নির্মাণে এত খরচ কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। রাজধানীতে বসবাসের জন্য অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত জোনে উচ্চ দামে জমি কিনে আবাসনেও সরকারের এত টাকা খরচ হওয়ার সুযোগ নেই। মতিঝিলে বিশাল এলাকাজুড়ে গণপূর্ত যেন ‘সোনা দিয়ে ফ্ল্যাট নির্মাণ’ ব্যয় ধরেছে।

প্রকল্পের আওতায় মতিঝিলে আল হেলাল জোনের ১০ দশমিক ২৫ একর জমিতে গড়ে তোলা হবে ১০টি ভবন। এর মধ্যে থাকবে আটটি আবাসিক ভবন, একটি মাল্টিপারপাস ভবন এবং একটি জেনারেটর-সাবস্টেশন ভবন। প্রতিটি আবাসিক ভবন হবে ২৫ তলা। এতে ৭৩৬টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৮০০ বর্গফুটের ৯২টি, ১৫০০ বর্গফুটের ৩৬৮টি এবং ১২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট হবে ২৭৬টি। এর বাইরে মাল্টিপারপাস ভবনে থাকবে লাইব্রেরি, জিমনেশিয়াম, ফার্মেসি ও রিক্রিয়েশন সেন্টার। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরে কাজ শুরু হয়ে ২০২৯ সালে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই ভবন তৈরির অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কর্মকর্তারা বিদেশে ভ্রমণ করবেন, যার ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় কোটি টাকা।

প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ভবন নির্মাণে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যয় হবে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে প্রায় ৬২২ কোটি, ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৪৯২ কোটি এবং ২০২৮-২৯ অর্থবছরে ব্যয় করা হবে প্রায় ৪৮৪ কোটি টাকা। বর্তমানে এলাকাটিতে ২৮টি আবাসিক ভবন রয়েছে, যা ১৯৫৫ সালের দিকে নির্মাণ করা হয়েছিল।

প্রকল্পটিতে অবকাঠামোগত পরিকল্পনা ছাড়াও নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন ও বিলাসী উপকরণ যুক্ত করা হয়েছে। যেমন—আটটি ভবনের প্রতিটিতে চারটি করে মোট ৩৪টি লিফট বসাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। প্রকল্প এলাকায় থাকবে ২২৩০ বর্গমিটার আয়তনের একটি পুকুর, যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটার পুকুর খননে ব্যয় হবে প্রায় ৩২ হাজার টাকা। খেলার মাঠের জন্য বরাদ্দ ৫ কোটি টাকা, শিশু পার্কের জন্য ২ কোটি, অ্যাম্পিথিয়েটারের জন্য ৪ কোটি ৫৫ লাখ এবং হাঁটার পথ বা জগিং ট্র্যাক তৈরিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা।

এর বাইরেও রয়েছে একটি ‘ঘাট’ নির্মাণের পরিকল্পনা, যার আয়তন মাত্র ৩৪৫ বর্গমিটার। এ ঘাট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটারে ৪৪ হাজার টাকা। ভবনের সিঁড়ি ও লবি মার্বেল পাথরে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আলংকারিক ফিনিশিং বা ‘ডেকোরেটিভ ওয়ার্কস’ বাবদ সব মিলিয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যও আছে আলাদা পরিকল্পনা। প্রকল্পে থাকবে ১৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সাবস্টেশন, ৮ কোটি ১০ লাখ টাকার একটি ইমার্জেন্সি জেনারেটর, ১৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ফায়ার সেফটি সিস্টেম এবং ৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকার সিসিটিভি ব্যবস্থা। এ ছাড়া রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংয়ের জন্য ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ভূগর্ভস্থ জলাধার নির্মাণে ৪ কোটি ২১ লাখ এবং দুটি গভীর নলকূপ বসাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি টাকা।

আবার এসব ভবনের চারপাশ ঘিরে ৮১৯ মিটার দৈর্ঘ্যের বাউন্ডারি ওয়াল ও গেট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা—প্রতি মিটারে প্রায় ৬১ হাজার টাকা। ডাস্টবিন নির্মাণেও রয়েছে চমক। মাত্র ১০টি আরসিসি ডাস্টবিন নির্মাণে বরাদ্দ ৪০ লাখ টাকা।

এ ছাড়া প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্মানী বাবদ ৪০ লাখ, গাড়ি ভাড়া বাবদ ৭০ লাখ এবং স্টেশনারি, সিল, স্ট্যাম্প, আপ্যায়ন ও বিজ্ঞাপনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে কোটি টাকা। প্রকল্পে একটি গাড়ি, একটি মাইক্রোবাস এবং দুটি মোটরসাইকেল কেনার প্রস্তাব রয়েছে। আটজন কর্মকর্তার বেতন হিসেবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৭ লাখ টাকা।

প্রকল্পটিতে আরও একটি ব্যতিক্রমী ব্যয়ের খাত রয়েছে, যা হলো বিদেশ সফর। নকশা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা সাত দিনের বিদেশ সফরে যাবেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

প্রকল্পের ১৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের জন্যে ২৫ তলা একটি ভবনের ব্যয় ধরা হয়েছে ২০২ কোটি ৪২ লাখ। ১৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের চারটি ২৫ তলা ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে ৭৫০ কোটি, আর ১২৫০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের ৩টি ২৫ তলা ভবনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

ভবন এলাকায় একটি ফুটবল ও ক্রিকেট কম্বাইন্ড ফিল্ড (খেলার মাঠ) তৈরিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি, ১টি চিলড্রেন প্লে জোন তৈরিতে ২ কোটি টাকা এবং সেফটি ক্যানোপি উইথ সেফটি নেট ১৩ কোটি ৬৮ লাখ ও সেফটি রোড ক্যানোপি খাতে ব্যয় হবে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

এ ছাড়া ইন্টারকম সিস্টেমের জন্য ১ কোটি ১৪ লাখ, ইউটিলিটি ভবনের জন্য ১০০ টনের স্প্লিট টাইপ এয়ার কুলারে দেড় কোটি, বজ্র নিরোধক ব্যবস্থায় ২৫ লাখ, আসবাবপত্র (পিডি অফিসের) ৮ লাখ, আরবরিকালচার ৬ কোটি এবং ২৫ হাজার ২৯৩ ঘন মিটার ভূমি উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

ডিপ টিউবওয়েল ১৫০ মিমি: দুটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ভূগর্ভস্থ জলাধারে (অগ্নিনির্বাপক) ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ২১ লাখ, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ৯টির ব্যয় ২ কোটি ৭০ লাখ, একটি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টের ব্যয় ৪ কোটি, ডিস্ট্রিবিউশন লাইন, ওয়াটার পাম্পের ১টি কাজের ব্যয় ২ কোটি ৩৩ লাখ এবং ৩৪টি সেফটি ট্যাঙ্কের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা।

সরকারি যুক্তি হলো, ঢাকায় কর্মরত ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিপরীতে মাত্র ১৪,৮০০টি আবাসিক ফ্ল্যাট রয়েছে, যা চাহিদার মাত্র এক শতাংশ। এ ঘাটতি কমিয়ে আনতেই উন্নতমানের বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী ভবিষ্যতে ৪০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সরকারি ফ্ল্যাটে বসবাসের সুযোগ করে দিতে চায় সরকার।

তবে প্রশ্ন উঠছে—এই প্রকল্প কেবল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য, কর্মচারীদের জন্য নয়। অর্থাৎ যারা প্রকৃতপক্ষে আবাসন সংকটে বেশি ভোগেন, তাদের জন্য প্রকল্পে কোনো বরাদ্দ নেই। অন্যদিকে, মার্বেল পাথরের সিঁড়ি, বিলাসবহুল গেট, পুকুর, অ্যাম্পিথিয়েটার, বিদেশ সফর ও ঘাটের মতো ব্যয়বহুল খাত যুক্ত করে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বাজারদরের তুলনায় এসব খাতে ব্যয় কয়েকগুণ বেশি।

এ প্রসঙ্গে একজন স্থপতি কালবেলাকে বলেন, ‘মতিঝিলের মতো জায়গায় ১০ একর জমি ব্যবহার করে আরও বহু ফ্ল্যাট নির্মাণ করা যেত। এখানে মধ্যম আয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যও সুযোগ রাখা যেত; কিন্তু প্রকল্পটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন এটি একটি সরকারি কনডোমিনিয়াম। প্রতিটি ধাপে রয়েছে বিলাসিতা, চমক ও শোভা; কিন্তু গণসেবার ছাপ কম।’

অন্যদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি একটি পাইলট প্রকল্প। সরকারি কর্মকর্তাদের আধুনিক জীবনমান নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য। তবে খরচের বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেট ঘাটতির সময়ে জনগণের করের অর্থে এমন বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানিসম্পদ, পরিবেশসহ নানা খাতে বরাদ্দ সংকুচিত হচ্ছে, সেখানে মাত্র ৭৩৬ জন কর্মকর্তার জন্য ১৮শ কোটি টাকার এ আয়োজন কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের মতিঝিল জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন কালবেলাকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের কাজ চলমান। এখন আমি এই জোনের দায়িত্বে আছি। প্রকল্প পাস হলে, তখনো যদি দায়িত্বে থাকি, তাহলে দায়িত্ব পালন করব। প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছে কি না, সেটা আমি জানি না, দায়িত্বপ্রাপ্ত বড় স্যাররাই বলতে পারবেন।’

জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, ‘এ প্রকল্প প্রস্তাবিত, এখনো পাস হয়নি। এ প্রকল্প শুধু কর্মকর্তাদের জন্য হলেও অন্যান্য প্রকল্প কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার জন্য নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে অতিরিক্ত অর্থ ধরা হয়নি। সরকারি যে নিয়ম আছে, সে নিয়ম অনুযায়ী ব্যয় ধরা হয়েছে।’

তবে প্রস্তাবিত প্রকল্পকে বিপুল ব্যয়ের বিলাসী প্রকল্প বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। স্থপতি ইকবাল হাবিব কালবেলাকে বলেন, ‘এলাকার জনঘনত্ব দেখে আবাসিক ভবন নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়। সবকিছু দেখে ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী পরিকল্পনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য ইমারত বিধিমালা সমান। আবাসিক ভবন করার ক্ষেত্রে এলাকার ঘনত্ব দেখে যেমন ভবন নির্মাণ করতে হয়, তেমনি এসব আবাসিক প্রকল্পে বাচ্চাদের জন্য খেলাধুলার মাঠ, রাস্তাসহ বিভিন্ন কিছু রাখতে হয়।’

ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি বর্গফুটে ব্যয় ৪ হাজার টাকা করে হতে পারে উল্লেখ করে এই স্থপতি বলেন, ‘৭৩৬ জন কর্মকর্তার জন্য প্রায় ১৮শ কোটি টাকা খরচ একটি বিলাসী প্রকল্প। তবে এই প্রকল্পে আনুষঙ্গিক খাতে কী পরিমাণ ব্যয় রাখা হয়েছে, সেটা জানতে হবে।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সার্কেল-১-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. খালেদ হুসাইনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও কোনো সাড়া মেলেনি।