Image description

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে যেন ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের চিনিকলগুলো। বিগত ১৫ বছরের বেশির ভাগ সময়ই লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকই উৎপাদন করতে পারেনি চিনিকলগুলো। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর সেই মিলগুলো লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি চিনি উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে।

চলতি ২০২৪-২৫ মৌসুমে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন সাতটি চিনিকলের মোট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়কে ধরা হয় চলতি মৌসুম। এ সময় চিনিকলগুলো উৎপাদন করেছে ৪৬ হাজার ১৮৭ মেট্রিক টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চিনি উৎপাদন বেশি হয়েছে এক হাজার ১৮৭ মেট্রিক টন। ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের মুখে ঢেলে দেওয়া মিলগুলো আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

বন্ধ হওয়া চিনিকলগুলো হলোÑপঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, রংপুর, শ্যামপুর, পাবনা ও কুষ্টিয়া। কিন্তু এসব চিনিকল কেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিএসএফআইসির কর্মকর্তারাও অন্ধকারে ছিলেন।

বিএসএফআইসির আখ উৎপাদন ও সম্প্রসারণ (সিপিই) বিভাগের প্রধান গিয়াস উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, ২০১৯-২০ মৌসুমে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় কৃষকের ঋণ সরবরাহের অনুমতিও দেওয়া হয়নি। ফলে লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি উৎপাদনেও বড় ধরনের ধস নামে। তিনি আরো বলেন, সঠিক সময়ে ঋণ না পাওয়ার কারণে আখচাষে কৃষকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। বর্তমান সরকার আখের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি এর উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ায় আখের ফলন বেড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ায় আখচাষিদের পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হয়েছে। ফলে ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান করা গেছে।

বিগত সরকারের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো আধুনিকায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোনো রকমে উৎপাদন চালানোর মতো কিছু মেশিনারিজের সংযোজন করা হলেও সরকারের কাছ থেকে ট্রেড গ্যাপ ও ভর্তুকি হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের খুব সামান্যই ছাড় পাওয়া গেছে। অন্যদিকে পরিচালনা ব্যয় বাবদ সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত ঋণ সহায়তা পাওয়া যায়নি। ফলে আর্থিক সংকটের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল সরকারি চিনিকলগুলো।

মূলত মিলগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পরিবর্তে ধীরে ধীরে তা বন্ধ করে দেওয়ার নীতিই গ্রহণ করা হয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। ওই নীতির আলোকেই লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ছয়টি চিনিকল। ২০২৪ সালের ৪ জুলাই মাসে দখলদার ব্যবসায়ী গ্রুপ হিসেবে আলোচিত ও বিতর্কিত এস আলমের হাতে চিনিকলগুলো তুলে দেওয়ার চুক্তি করেছিল বিএসএফআইসি। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর সে চুক্তি বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দেওয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনির উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। মূলত চিনিকলগুলো বন্ধ করে বেসরকারি কোম্পানির হাতেই চিনির বাজার তুলে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, যেসব মিলের ভূমির পরিমাণ বেশি, সেসব মিলই টার্গেট করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আবার ওইসব মিল এলাকায় আখের চাষও বেশি হয়। ফলে আখ উৎপাদন ব্যাহত করে পরবর্তী সময়ে অন্যান্য মিলগুলো হয়তো বন্ধ করে দেওয়া হতো। কারণ উৎপাদন কমে গেলে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যেত। আর সরকার নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রির কারণে মিলগুলোকে লোকসান গুনতে হতো। প্রয়োজনীয় ভর্তুকি না দিয়ে উল্টো রাষ্ট্রের জন্য বোঝাÑএমন অজুহাত দেখিয়ে মিলগুলো বন্ধের একটি পাঁয়তারা ছিল। এস আলমের মতো কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিল, দেশের চিনিকলগুলোও তা থেকে রেহাই পেত না বলে মন্তব্য করেন তিনি ।

বন্ধ চিনিগুলোকে আবারও চালু করে উৎপাদনমুখী করার ঘোষনা দিয়েছেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দেওয়ার কারণে চিনির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ থেকে কমে ৫০ হাজারের ঘরে নেমে এসেছে। কিন্তু সে লক্ষ্যেরও অর্ধেক অর্জিত হয়নি।

তথ্যে দেখা যায়, চলতি মৌসুমে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের পাঁচ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টনের বিপরীতে পাঁচ হাজার ৯৩২ মেট্রিক টন, জয়পুরহাট চিনিকলে দুই হাজার ৭৫০ মেট্রিক টনের বিপরীতে দুই হাজার ৭৩২ মেট্রিক টন, রাজশাহী চিনিকলে তিন হাজার ২০ মেট্রিক টনের বিপরীতে তিন হাজার ৫৬৭ মেট্রিক টন, নাটোর চিনিকলে পাঁচ হাজার ১৩০ মেট্রিক টনের বিপরীতে ছয় হাজার ১৪৮ মেট্রিক টন, নর্থবেঙ্গল চিনিকলে ১৩ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে এক হাজার ১৩৪২ মেট্রিক টন, কেরুর তিন হাজার ৮৫০ মেট্রিক টনের বিপরীতে তিন হাজার ৬৮৪ মেট্রিক টন, মোবারকগঞ্জ চিনিকলের তিন হাজার ৭৮০ মেট্রিক টনের বিপরীতে তিন হাজার ৮৬৮ মেট্রিক টন, ফরিদপুর চিনিকলে তিন হাজার ৫৭০ মেট্রিক টনের বিপরীতে চার হাজার ৩৩১ মেট্রিক টন এবং জিলবাংলা চিনিকলে চার হাজার ৫৫০ মেট্রিক টনের বিপরীতে চার হাজার ৫৯৯ মেট্রিক টন চিনি উৎপদিত হয়েছে।

এদিকে আখ থেকে চিনি আহরণের হারও গত মৌসুমের তুলনায় বেড়েছে। গত মৌসুমে আখ থেকে চিনি উৎপাদনের হার ছিল ৫.০৭ শতাংশ। আর চলতি মাড়াই মৌসুমে এ হার বেড়ে হয়েছে ৫.৫০ শতাংশ।

চিনি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারের সহায়তা বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে বিএসএফআইসি কর্মকর্তারা জানান। তারা বলেন, চলতি মৌসুমে পরিচালন ঋণ হিসেবে ৪০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়ায় আখচাষিদের সময়মতো তাদের পাওনা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে মিল কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার কারণে এবারের মৌসুমে ৯টি মিলের মধ্যে সাতটি মিলই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি চিনি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে।