Image description
ইরান-ইসরাইল তুমুল লড়াই । প্রথম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান । ৫০টির বেশি যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে হামলা ।

রণফুলকি ছুটছে মধ্যপ্রাচ্যে। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে কে কখন ছারখার হয় বলা মুশকিল। অন্তত আগামী ২৪ ঘণ্টায় এর কোনো পূর্বাভাস নেই। ‘নাটের গুরু’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার নিজেই এই ‘বিপজ্জনক’ ইঙ্গিত দিয়েছেন পৃথিবীর কানে। কানাডার জি-সেভেন সম্মেলন শেষের আগেই ফেরার পথে এক্স পোস্টে বলেন, ‘আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বোঝা যাবে ইসরাইলের হামলার গতি কমবে না বাড়বে।’ সে হিসাবে আগামী ২৪ ঘণ্টা কতটা ভয়ংকর হবে; কতটা লোমহর্ষক হবে তার ‘দিকদিশা’ নেই।

তবে দমকা হাওয়া লাগা যুদ্ধ-আগুনের আঁচ যে কোনো মুহূর্তে আগ্নেয়গিরির মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের মরু রাজনীতিতে তা স্পষ্ঠ। ট্রাম্পের গত দুদিনের উত্তপ্ত পোস্ট-বিবৃতিতে তা পরিষ্কার। ইসরাইল নয়-যুদ্ধ যেন যুক্তরাষ্ট্রই করছে। মঙ্গলবারের আরেক পোস্টে প্রথমবারের মতো সেই গোমরই ফাঁস করলেন ট্রাম্প। বললেন, ‘ইরানের আকাশ এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে।’ পরক্ষণেই বললেন, ‘ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কোথায় লুকিয়ে আছেন আমরা জানি। কিন্তু তাকে আমরা এখনই হত্যা করব না।’ তারপরই আবার বললেন, ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে ইরানকে।’ অর্থাৎ যুদ্ধ এখন আর ইসরাইলের সঙ্গে নেই। নিঃসঙ্গ ইরানের প্রতিপক্ষ বিশ্ব বিশৃঙ্খলার খলনায়ক যুক্তরাষ্ট্র নিজেই। সে হিসাবে আগামী ২৪ ঘণ্টা দূর কি বাত-একটু পর কী ঘটতে যাচ্ছে; কী হবে তা পুরোটাই ধোঁয়াশায়!

বড় যুদ্ধের এমন টানটান দশার মধ্যেই সমানে একে অন্যের ভূখণ্ডে হামলা-পালটা হামলা অব্যাহত রেখেছে ইরান-ইসরাইল। সংঘাতের ষষ্ঠ দিনে এদিন প্রথমবারের মতো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। এদিকে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ দাবি করেছেন, তাদের যুদ্ধবিমান ইরানি সরকারের ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সদর দপ্তর’ ধ্বংস করেছে। ইসরাইলি চ্যানেল ১২-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, তেহরান ও আশপাশে ইরানের সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি বিমানবাহিনী। তবে ইরানের পক্ষ থেকে এখনো এই দাবির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। ইরানের দুটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রেও হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের দুটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। খবর আলজাজিরার।

বুধবার এক এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টে আইএইএ জানায়, ইরানি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্র টিইএসএ কারাজ ও তেহরান রিসার্চ সেন্টারে হামলা হয়েছে। দুটি কেন্দ্রই এক সময় আইএইএর নজরদারির আওতায় ছিল।

এর আগে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী দাবি করে, তারা ৫০টির বেশি যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে হামলা চালিয়েছে। হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল ইরানের সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রসহ একাধিক অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র।

টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপক প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা নির্দেশনার ভিত্তিতে এই হামলা চালানো হয়।

ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কথা বরাবর অস্বীকার করে এসেছে। দুটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রে ইসরাইলি হামলার বিষয়ে ইরানের দিক থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি।

ইরানের রাজধানী তেহরান ও এর আশপাশের এলাকায় নতুন করে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, করাজ শহরের পায়াম বিমানবন্দরের কাছে বিস্ফোরণ হয়েছে। এর আগে এই বিমানবন্দরটিই ইসরাইলি হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল। এছাড়া তেহরানের পূর্বাঞ্চল থেকেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত এসব বিস্ফোরণের লক্ষ্যবস্তু বা ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ইরানি সরকারের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, দেশটির অন্তত দুটি ব্যাংকে সাইবার হামলা হয়েছে। ক্ষতির মাত্রা উল্লেখ না করলেও তিনি জানিয়েছেন, দেশের সাইবার অবকাঠামো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্যই সাময়িকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারে কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। তেহরানে ইসরাইল-ইরান চলমান উত্তেজনার মধ্যে এসব বিস্ফোরণ ও সাইবার হামলার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক অধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টস বলছে, ইরানজুড়ে ইসরাইলের হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৮৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত ১ হাজার ৩২৬ জন। খবর আলজাজিরার। সংগঠনটি বলেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৩৯ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ১২৬ জন নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যকে তারা শনাক্ত করতে পেরেছে। ইসরাইলি হামলায় হতাহতের বিষয়ে সর্বশেষ সোমবার তথ্য জানিয়েছে ইরান সরকার। দেশটির সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ২২৪। আর আহত হয়েছেন ১ হাজার ২৭৭ জন মানুষ। খবর আলজাজিরার।

চলমান সংঘাতে ইরান সরকার নিয়মিত হতাহতের তথ্য প্রকাশ করছে না। সবশেষ সরকারি তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল সোমবার। সেই তথ্য অনুসারে, ২২৪ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ১ হাজার ২৭৭ জন মানুষ।

গোলান মালভূমিতে ইরানি ড্রোন ভূপাতিত : ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা গোলান মালভূমির দক্ষিণাঞ্চলে অনুপ্রবেশকারী একটি ইরানি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। ড্রোনটি ইরানি ভূখণ্ড থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল বলে জানানো হয়েছে। এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলেছে, সিরিয়ার ইসরাইল অধিকৃত গোলান মালভূমির দক্ষিণ অংশে ড্রোনটি ঢোকার পর সেখানে সতর্কতা সংকেত (অ্যালার্ট) চালু হয়। এরপরই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সেটি গুলি করে নামানো হয়। ড্রোনটি ইরান থেকে সরাসরি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল বলেও বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে।

ঘটনার সময় বা ড্রোনের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি সেনাবাহিনী। তবে ঘটনার সময় ইসরাইল-ইরান উত্তেজনা তুঙ্গে থাকায় বিষয়টি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে : ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ জানিয়েছেন, দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে এখন ‘ধাপে ধাপে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার’ প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে। তিনি এটিকে ইরানের বিরুদ্ধে ‘বিজয়ের বার্তা’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।

ইসরায়েল কাৎজ বলেন, জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনার ভিত্তিতে অর্থনীতি ও বিভিন্ন অঞ্চল ধীরে ধীরে চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত মিলছে যে, ইসরাইল সরকার ইরানের দিক থেকে আক্রমণের ঝুঁকি কমে এসেছে বলেই মনে করছে।

তবে কাৎজ বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চলবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত সব হুমকি দূর হয়।