Image description
১১ মাসে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা সরকারি খাতের ঋণ প্রায় ২৩ লাখ কোটি টাকা

ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব। বিনিয়োগে ভাটা। ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা। লাগামহীন সুদের হারে ব্যবসা-উদ্যোগে স্থবিরতা।

পতনে জেরবার পুঁজিবাজার। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। অর্থবছরের শেষ দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে টানা কর্মবিরতি। এত সব বাধার মুখে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির মুখে সরকার।
 
বলতে গেলে থমকে গেছে অভ্যন্তরীণ আয়। এতে টান পড়েছে সরকারের কোষাগারে। কাঙ্ক্ষিত আয় না হওয়ায় অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কিন্তু থেমে নেই ব্যয়।
 
একদিকে আয় কমে যাওয়া, অন্যদিকে ব্যয় বেড়ে যাওয়া বা বাজেট বাস্তবায়নে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। এ জন্য বাড়ছে ধারকর্জ। দায়দেনার ভারে এ পর্যন্ত সরকারের ঋণ ছুঁয়েছে ২৩ লাখ কোটি টাকার অঙ্ক।

জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের ঘাড়ে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে হিসাবে প্রতি মাসেই এনবিআরকে আদায় করতে হতো ৪০ হাজার কোটি টাকা।

এই লক্ষ্য অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয় জেনে পরে লক্ষ্য কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছিল। ছোট করা লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করতে পারছে না সংস্থাটি। প্রতি মাসে প্রায় ৩৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকার মতো আদায় করার কথা। সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে গত ১১ মাসে ঘাটতি ছাড়িয়েছে লাখ কোটি টাকা।

সংশোধিত লক্ষ্য অনুযায়ী মে মাস পর্যন্ত ১১ মাসে আদায় হওয়ার কথা চার লাখ ২৪ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। অথচ প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এই সময়ে আদায় হয়েছে তিন লাখ ২২ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত আদায়ের তুলনায় এক লাখ দুই হাজার ৬৪২ কোটি টাকা কম। সে হিসাবে জুন মাসে লক্ষ্য পূরণ করতে হলে আদায় করতে হবে এক লাখ ৪১ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা।

প্রতিবছরই আয়ের তুলনায় সরকারের ব্যয় বেশি। বাজেটেও সেভাবেই খরচের প্রাক্কলন করা আছে। কিন্তু আয় না হলেও বাজেটের প্রাক্কলন ধরে খরচ মেটাতে সরকারকে বিদেশি উৎস, দেশের ব্যাংকব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র থেকে ধার করতে হচ্ছে। এতে সরকারের দায়দেনা বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০৩.৬৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে) ১২ লাখ ৬৪ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে অর্থ বিভাগের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ঋণের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশীয় উৎস থেকে ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি উৎস থেকে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২২ লাখ ৯৯ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) মোট ৪৮ হাজার ৬১৫ কোটি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। একই সময়ে গ্রাহকের আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ ৪৩ হাজার ৪৭৬ টাকার দায় শোধ করতে হয়েছে। এ দায়ও প্রতিদিনই বাড়ছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫১৬ কোটি ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যা ৬২ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ ৫১ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। এর পেছনে নিয়মিতভাবে সরকারকে সুদ দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া মুদ্রার বিনিময় হারের ঊর্ধ্বগতির কারণেও ঋণের কিস্তি ও সুদের পেছনে সরকারের দায় বাড়ছে।

বড় ঋণ মাথার ওপর থাকার পরও আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এর পরিমাণ আরো বাড়বে। এ ছাড়া দেশি উৎস থেকে ঋণ প্রাক্কলন করা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বিদেশি উৎস থেকে ঋণ ধরা হয়েছে ৯৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের আকার সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আগের তুলনায় বাজেটের আকার প্রায় সমান থাকলেও বেড়েছে রাজস্ব লক্ষ্য। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের ঘাড়ে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা।

জানা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করায় ঠিকমতো কর দিতে পারছে না ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার ব্যক্তিগত আয়করও আদায় হচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত হারে। একই ভাবে ব্যবসায় মন্দার কারণে এ থেকে কাঙ্ক্ষিত ভ্যাট আদায় কমে যাচ্ছে। আমদানি কমে যাওয়ার কারণে ওই খাত থেকেও ঠিকমতো শুল্ক আদায় হচ্ছে না। সব মিলিয়ে সরকারের যে অভ্যন্তরীণ আয়ের ওপর নির্ভরতা, সেটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তারই প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আয়ে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘাটতি মেটানোর জন্য ঋণ নেওয়া ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা ব্যাংকিং খাত থেকে এই ঋণ নিয়েই হয়তো এই ঘাটতি মেটানো হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিলে ব্যাংকগুলোর জন্য একটা অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। বেসরকারি খাতের প্রাপ্যতা অনুযায়ী ঋণ পাবে না। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। রাজস্ব ঘাটতি হলে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সব চলকের ওপরও একটা অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে।

রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতির মুখে থাকলে দেশ একটা ঋণচক্রের মধ্যে পড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, বড় ঘাটতি থাকলে আগামী অর্থবছরের বাজেটের ব্যয় ও ঋণের প্রাক্কলনের চিত্র উল্টেপাল্টে যাবে। রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি দেখা দিলে আমাদের ঋণও বেড়ে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় আয়কর, করপোরেট কর, পরোক্ষ কর থেকে শুরু করে সব জায়গায়ই প্রভাব ফেলেছে। আমদানি কার্যক্রমও শ্লথ ছিল, প্রবৃদ্ধিও মাত্র ৬ শতাংশের মতো। এটা ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যার একটা প্রতিফলন। এসব কাটিয়ে উঠতে না পারলে ব্যয় করতে পারব না। ঋণচক্রে পড়ে যাব।

সমস্যা সমাধানে করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় চাঙ্গা করতে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা-সক্ষমতা ও সুশাসনের দিকে নজর দিতে হবে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষ উন্নত করে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। তবে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে এই চ্যালেঞ্জ আরো বাড়তে পারে।

রাজস্ব আদায়ের সামগ্রিক চিত্র প্রসঙ্গে জানতে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ প্রক্রিয়ায়ই একটা সমস্যা আছে। এ ছাড়া ঘটনাবহুল অর্থবছরে সরকার পরিবর্তন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ছন্দঃপতন, আমদানিতে ধস এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। তারপর সবার অগোচরে রাতের অন্ধকারে অধ্যাদেশ জারি করায় অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। ফলে রাজস্ব আদায়ে একটা বড় প্রভাব পড়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ না হলে সংকট আরো বাড়বে।

রাজস্ব আদায় বাড়াতে করণীয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসএমএসি অ্যাডভাইজারি সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া এফসিএ কালের কণ্ঠকে বলেন, এনবিআরের কাছে সব করদাতার ডেটাবেইস আছে। যাঁরা রিটার্ন দেন না তাঁদের চিহ্নিত করে যোগাযোগ ও রিটার্ন দাখিলে উৎসাহিত করা উচিত। পিএসআর পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। অনেক করদাতা সম্পত্তি স্বচ্ছভাবে রিটার্নে দেখান না। ফলে এনবিআর সঠিক তথ্য পাচ্ছে না এবং সম্পত্তি গোপন থাকছে। সার্ভারে তথ্য একীভূত করে এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, সবাই পরোক্ষ কর দেন। কিন্তু এর পুরোটা সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। আমদানি বা উৎপাদন পর্যায়ে আদায় হলেও পরিবেশন ও খুচরা পর্যায়ে কর আদায় হয় না। ইএফডি, এসডিসি ও ইএফডিএমএস চালু হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল নেই। উৎপাদন পর্যায়ে ই-ইনভয়েসিং ও পরের ধাপে ক্যাশলেস সিস্টেম চালু না করলে লেনদেন শনাক্ত করা যাবে না। ফলে ভ্যাট আদায় হবে না এবং সমান ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে না।