দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে বেশ তৎপর সরকার। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এর মধ্যে দুটি বৈঠকও করেছে টাস্কফোর্স। আজ রবিবার এর তৃতীয় বৈঠক রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
টাস্কফোর্স সভার কার্যবিবরণী ঘেঁটে জানা গেছে, পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়েছে, চলছে অভ্যন্তরীণ তদন্তও। তবে সম্পদ ফেরানোয় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাচারকারীদের সম্পদের তথ্যের ঘাটতি। অর্থ পাচারকারী ব্যক্তি বা কোম্পানির নামে রক্ষিত সম্পদের প্রকৃত তথ্য সরকারের কাছে না থাকায় তা উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে, তারা ফিরিয়ে দিতে চায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়াটি বেশ কঠিন ও দুঃসাধ্য। গত ২ নভেম্বর এক সেমিনারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও চালান জালিয়াতি, দেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের পাঠানো অর্থ, ভিসা ও অভিবাসন ব্যয়, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া এই অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে এটি অত্যন্ত কঠিন এবং প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও বলছে, বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার আরও বেশি কঠিন। অর্থ পাচারের নথিপত্র সংগ্রহ, পাচারের গতিপথ নির্ধারণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও পাচার হওয়া দেশের আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করতে সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সময় লাগবে। আর বিষয়বস্তু ও প্রক্রিয়া জটিল হলে কোনো কোনো মামলা শেষ হতে ১৫-২০ বছর সময় লাগতে পারে।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের ইচ্ছে রয়েছে। তবে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ কোনো দেশই পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। তবে টাকা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই সফলতা পাওয়া যায় না। কারণ যেসব দেশে টাকা গেছে, তারা চায় না টাকা ফিরে যাক। তৃতীয় বিশে^র দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশ থেকে বেশি পাচার হয়েছে। যারা ব্যাংকঋণ নিয়ে টাকা ফেরত দেয়নি, ঘুষ খেয়েছে এবং ঠিকাদারি করেছে; তারাই মূলত এসব টাকা পাচার করেছে। বর্তমান সরকার টাকা পাচার অনেকটাই বন্ধ করেছে। যার প্রভাবে রিজার্ভ বেড়েছে।
জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল (ক্রীড়নক), আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত অর্থনীতি নিয়ে তৈরি শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে টাকা পাচারের আনুমানিক এই চিত্র তুলে ধরা হয়।
অন্যদিকে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জিএফআই, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সহায়তার কথা জানালেও বাস্তবে এসবের অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো নয়।
কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের সভায় জানানো হয়েছে, পাচারে জড়িত সন্দেহভাজনদের তথ্য দেওয়ার বিলম্বের কারণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ইলেকট্রনিক ডাটাবেজ না থাকা। সন্দেহভাজন ব্যক্তির তথ্যপ্রাপ্তির পর তা সারা দেশের ৫৭০টি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে পাঠানো হয়। অফিসগুলো ইনডেক্স (বালাম/ভলিউম) বই থেকে ব্যক্তির নাম, পিতার নাম এবং ঠিকানা দিয়ে ম্যানুয়ালি অনুসন্ধান করে তথ্য দেয়। অনুসন্ধানী সংস্থাগুলো প্রায়শই সন্দেহভাজন ব্যক্তির নাম এবং জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ জানায়। সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে রক্ষিত ইনডেক্স বইগুলোতে জমির মালিকের এনআইডি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, বিধায় শুধু নাম ব্যবহার করে সঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জিং। তার ওপর কিছু সাবরেজিস্ট্রি অফিস গত ৫-৭ বছরে তাদের ইনডেক্স বই আপডেট করেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধানী সংস্থাগুলোর চাওয়া তথ্য প্রদান সময় বেশি লাগে এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুষ্কর।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন এক ডজন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অনুসন্ধান করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। ইতোমধ্যেই সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের বিদেশে সম্পদ অর্জনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকেও জাভেদের সম্পদের তালিকা সিআইসিতে পাঠানো হয়েছে। এইসব সম্পদ জাভেদ নিজের ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ করেননি। কর ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় জাভেদের সম্পদ জব্দের দিকে এগোচ্ছে সিআইসি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাভেদ আয়কর বিভাগে যেই রিটার্ন জমা দিয়েছেন, তাতে তার সম্পদের পরিমাণ ১৮ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়। আয় দেখান ৭৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে তিনি আয়কর দিয়েছেন মাত্র ১৯ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিনি সম্পদ দেখিয়েছেন মাত্র ১৭ কোটি টাকার। আর বছরে মোট আয় দেখিয়েছেন মাত্র ৭৪ লাখ টাকার। আর দুটি গাড়ি থাকলেও তিনি আয়কর ফাইলে একটির কথা উল্লেখ করেছেন। আয়কর ফাইলে দেখানো গাড়ির দাম উল্লেখ করেছেন ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ টাকা। আয়কর নথিতে ব্যাংকের স্থিতি দেখিয়েছেন ১ কোটি ৮৬ লাখ ৭২ হাজার ২৩৫ টাকা। অথচ সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সাবেক এই মন্ত্রী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ব্রিটেন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াতেও তিনি ৫শরও বেশি বাড়ি কিনেছেন। যেগুলোর মূল্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৮ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকারও বেশি।