ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতা বা সংসদের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখছে। দল গোছানোসহ সাংগঠনিক ভিত মজবুতকরণে উঠেপড়ে লেগেছে রাজনৈতিক দলগুলো। ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
এই পরিকল্পনা নিয়ে জামায়াত ইসলামী কয়েকটি ইসলামী দল ঐক্যের প্রচেষ্টাও চালায়। কিন্তু দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের বক্তব্যের পর এ ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আবুল আলা মওদূদীর ভ্রান্ত আক্বিদা সম্পর্কে রয়েছে আলেমদের ভিন্ন মত। তারা মনে করেন, আবুল আলা মওদূদী তার লেখনী ও বক্তব্যে নবী-রাসূল ও সাহাবা সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বিদা পোষণ করেছেন, যা এ দেশের হক্কানি ওলামায়ে কেরামের আক্বিদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী। জামায়াতে ইসলামী ভ্রান্ত আক্বিদা সংশোধনে সাড়া দেয়নি। একাধিক ইসলামিক দলের নেতা এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
হেফাজতের আমির আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী ও দেশের শীর্ষ মুফাসসিরে কোরআন মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলিপুরীসহ অনেক ওলামায়ে কেরামের বক্তব্যেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ঐক্যের পথে এই সমস্যাটি নতুন নয়; বরং ১৯৮১ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডাক দেন তখন সমস্ত ইসলামি দলের নেতারা ও অরাজনৈতিক আলেমরা হাফেজ্জীর ডাকে সাড়া দেন। ওই ঐক্যে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা অংশীদার হতে গেলে হাফেজ্জী হুজুর তাদেরকে মওদূদীর ভ্রান্ত আক্বিদাসমূহ সংশোধনের আহŸান জানান এবং পত্রিকায় এই মর্মে নিউজ প্রেরণ করতে বলেন। যা আজ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী করেনি।
জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী বলেছেন, ইসলামী দলসমূহ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এ প্রক্রিয়ায় কারা কারা থাকবে সে বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে যাতে একটি ব্যালট বক্স থাকে সে জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ঐক্য প্রক্রিয়া আরো জোরদার করেছি। ইতোমধ্যে আমরা বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশসহ অনেক দলের সাথে উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে মিলিত হয়েছি। আমাদের দলের আমির শত ব্যস্ততার মধ্যেও অন্যান্য ইসলামী দলের আমন্ত্রণে তাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহŸান জানিয়ে আসছেন। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত খেলাফত মজলিসের অধিবেশনে অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি স্পষ্ট ঐক্যের আহŸান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম দেশ ও মানবতা রক্ষায় ব্যক্তি বা দলের স্বার্থকে বড় করে না দেখে দুর্নীতি, দুঃশাসন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সিন্ডিকেট মুক্ত বাংলাদেশ যারা চাইবে তাদের সাথে আগামী নির্বাচনে ঐক্য অথবা নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।
মাওলানা মাদানী বলেন, উপরোক্ত বিষয়ে একমত হলে শুধু ইসলামী দলগুলোর সাথে নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথেও ঐক্য অথবা নির্বাচনী সমঝোতা করতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রস্তুত আছে।
জানতে চাইলে ইসলামিক মুভমেন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খায়রুল আহসান বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হলেও এটি কোনো ইসলামি দল নয়। কারণ আহলুসসুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার সাথে জামায়াতে ইসলামীর আক্বিদাগত পার্থক্য আছে। তাদের আক্বিদা মওদূদীর মূলনীতির উপর ভিত্তিতে গঠিত, এটি ইসলামি কোনো আক্বিদা নয়। আমরা বারবার কওমিপন্থী ইসলামি দলগুলোর জামায়াতের সাথে জোট গঠনের বিরোধিতা করে আসছি এবং কওমিপন্থীসহ সব ইসলামী দলকে জামায়াতের সাথে জোটে অংশগ্রহণ না করার আহŸান জানাই। তিনি বলেন, জামায়াত নির্বাচন দীর্ঘায়িত করে দল গুছানোর তৎপরতায় লিপ্ত যাহা বড় ছোট সব দলের জন্য হুমকির কারণ। জামায়াত এদেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী একাত্তরের স্বাধীতাবিরোধী দল হয়েও ফ্যাসিবাদের উৎখাতের প্রধান ভ‚মিকা পালনকারী ছাত্র-জনতা, আলেম ওলামা ও দলমত নির্বিশেষে সবার আন্দোলনের ফসল তাদের নিজের সফলতা হিসেবে প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে যা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে একাত্তরের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য প্রকাশ্যে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহŸান জানান। অন্যথায় তাদেরকে এদেশের আপামর জনতা কোনোক্রমেই গ্রহণ করবে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মাওলানা একে এম আশরাফুল হক বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দেশের সব ইসলামী রাজনৈতিক দলের ঐক্যের বিষয়ে ফেসবুকে মাঝে মধ্যে দেখি। বাস্তবে জামায়াতে ইসলামীসহ সব ইসলামী দলের ঐক্যের কোনো প্রক্রিয়া চোখে পড়ার মতো নয়। বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আমরা এমন কোনো প্রক্রিয়ার বিষয়ে অবগত নই। তবে দীর্ঘদিন যাবত রাজনৈতিক মূল ¯্রােতধারার বাইরে যেয়ে দেশের ইসলামী রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি সিন্ডিকেট তৈরির অপচেষ্টা চলে আসছে। যে সিন্ডিকেটের অনেকেই গত ১৬ বছর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সহযোগী ভ‚মিকা পালন করেছে। মাওলানা একে এম আশরাফুল হক আরো বলেন, শুধুমাত্র ইসলামের আবেগকে ব্যবহার করে রাজনীতির মূল স্কিম থেকে ইসলামী শক্তিকে দূরে সরিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস চলছে বলে মনে হচ্ছে। এর মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান ও মিসরের মতো একটি পুতুল সরকার দাঁড় করানো মিশন চলছে। যা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর হতে পারে এবং তাতে দেশের উন্নয়ন ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পুনঃপ্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করবে বলেও তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি সুলতান মহিউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর আদর্শের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। যে সব দলের ব্যাপারে হাফেজ্জী হুজুরের সতর্কবাণী রয়েছে তাদের সাথে খেলাফত আন্দোলন ঐক্য করবে না।
গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে ইসলামিক দলগুলো। আর তাতে নেতৃত্বে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে সবচেয়ে বড় ইসলামিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দল এবং সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে দলটি। বিগত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারত পালানোর দিন আলোচনায় আসেন জামায়াতে ইসলামীর আমির। তখন দলটি নিষিদ্ধ থাকলেও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিএনপির নেতার আগে জামায়াতের ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নাম উচ্চারণ করতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় আসে দলটি। যদিও তখন জামায়াতকে আওয়ামী লীগ অবৈধভাবে নিষিদ্ধ করেছিল। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর জামায়াতের উপর শেখ হাসিনা রেজিমের করা অবৈধ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহরের পর জামায়াতের আমির সক্রিয় হয়ে উঠেন। এর মধ্যে বিএনপি দ্রæত সংস্কার করে নির্বাচনের দাবি এবং জামায়াতের অন্তর্বর্তী সরকারকে দীর্ঘ সময় নিয়ে সংস্কারের পর নির্বাচন ইত্যদি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত মিলে এইচ এম এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ’৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি মিলে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করেছে।
উল্লেখ্য, গত ২১ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসায় বেফাক ও হাইয়াতুল উলিয়ার চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসানের আহŸানে ‘দেশ ও জাতির চলমান পরিস্থিতি ওলামায়ে কেরাম এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন দেশের প্রায় শীর্ষ অনেক ওলামায়ে কেরাম। সে সভায় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে উলামায়ে কেরাম বলেন, আমাদের আক্বিদার সাথে যাদের মিল রয়েছে তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য হতে পারে। তবে জামায়তসহ যে সব দলের আক্বিদা নিয়ে আপত্তি রয়েছে তাদের সাথে ঐক্য করা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এদিকে, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী গতকাল বলছেন, নির্বাচনী জোট গঠনে এখনো পর্যন্ত কারো সাথেই আমাদের কোনো প্রকার সমঝোতা হয়নি। আমরা মনে করি এ বিষয়ে চ‚ড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মতো সময় এখনো আসেনি, তবে সমমনা ইসলামী দলগুলোর সাথে এক প্রার্থীকেন্দ্রিক নির্বাচনী ঐক্যের বিষয়ে আমরা আশাবাদী। মাওলানা আফেন্দী বলেন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ নির্বাচনমুখী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সম্ভাবনাময়ী আসনসমূহে প্রার্থী তালিকা চ‚ড়ান্তকরণের প্রাথমিক কাজগুলো সম্পাদন করে যাচ্ছে। আশা করি এ তালিকা সন্তোষজনক সংখ্যায় থাকবে। তিনি ঐক্য প্রসঙ্গে বলেন, যে ঐক্য ইসলাম, দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে এবং যে ঐক্য ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে এক কাতারে আনবে সে ঐক্যকে আমরা বরাবরই স্বাগত জানিয়ে আসছি।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নির্বাহী সভাপতি আব্দুল আজিজ হাওলাদার বলেছেন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ গত ১৫ বছর কোনো জোটভুক্ত ছিল না। স্বৈরাচারী সরকারকে হটাও আন্দোলনে আমাদের অংশগ্রহণ ছিল। বিগত ১৪ ও ২৪ এর নির্বাচনে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ নিবন্ধন নং-০২১ অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু পবিত্র কোরআন নির্দেশিত জীবন ব্যবস্থা ও নবী করিম (সা.) এর আদর্শের যারা অপব্যাখ্যা করে এমন কোনো ইসলামী দল বা জোটের সাথে মুসলিম লীগ কখনো ছিল না। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকবে না। মুসলিম লীগ মুসলিম জাতিসত্তায় বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দল।