Image description

গত সপ্তায় লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনি তৎপরতায় নতুন গতি পেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা কেটে এখন স্পষ্ট হয়েছে নির্বাচন ঘিরে সময়রেখা। এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকায় সক্রিয় হয়েছেন, শুরু করেছেন ঘর গোছানোর প্রস্তুতিও।

লন্ডন বৈঠক সফল হওয়ায় বিএনপির পাশাপাশি তাদের সমমনা দলগুলোও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। বিবৃতি দিয়ে বলেছে, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়েছে। নির্বাচনের পথ সুগম হয়েছে। বিএনপির দলীয় সূত্রগুলোও বলছে, তাদের দৃষ্টি এখন নির্বাচনের দিকে। সে লক্ষ্যে পরবর্তী দলীয় কার্যক্রম ঠিক করা হবে।

রাজনৈতিক দলসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি সব সময়ই থাকে। তবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করবে দলটি। নাগরিক ঐক্য ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে। এলডিপি’র নির্বাচনী প্রস্তুতি থাকলেও তারা সমঝোতার ভিত্তিতে বিএনপি’র সঙ্গে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইছে। গণফোরাম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং গণঅধিকার পরিষদও দলগতভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোটের আগে বিএনপি’র সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য হলে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী দেবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, তাই সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনমুখী প্রস্তুতি সবসময়ই থাকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রার্থী বাছাই শুরু হয়নি। তফসিল ঘোষণার পরই মনোনয়ন চাওয়া শুরু হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনমুখী দল হিসেবে নির্বাচন কেন্দ্রিক একটি প্রস্তুতি সবসময়ই দলের থাকে এবং সে অনুযায়ীই এখন তারা কাজ করছেন।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “আমরা এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির একটি কৌশলগত পর্যায়ে রয়েছি। রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সম্ভাব্য জোটগত সমীকরণ বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন প্রস্তুতি পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি কার্যকর রাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করা, যার মাধ্যমে জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে।” বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বর্তমানে চলমান রয়েছে। মাঠপর্যায়ে কর্মী-সমর্থকদের সক্রিয় করা এবং দলীয় কাঠামোকে শক্তিশালী করার কাজে আমরা মনোনিবেশ করছি। বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা শুরু হয়নি, তবে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না।”

গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, “আমরা এখনো নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার অপেক্ষায় আছি। তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী বিএনপির সঙ্গে সম্ভাব্য সমঝোতা নিয়ে দলের ভেতরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। জনগণের প্রত্যাশা এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা পদক্ষেপ নেব।” গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান বলেন, গণফোরাম একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। আমাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি রয়েছে। গণফোরামের প্রত্যেক জেলা ইউনিটকে নির্বাচনী প্রস্তুতি কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, আমরা প্রার্থী বাছাই নিয়ে তত কাজ করবো।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, অনেক দিন ধরেই আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রার্থী তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। জেলা কমিটিগুলোও ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং করে চূড়ান্ত করবো। আর বিএনপি’র সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে আছি, এখন জোটগতভাবে আমরা নির্বাচনে অংশ নেবো কিনা, এ বিষয়ে অফিসিয়ালি এখনো কোনো আলোচনা হয়নি।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ বলেন, বিএনপি’র সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম, এখনো যুগপৎ আন্দোলনসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিএনপি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের যে সফলতা, এজন্য আমরা আনন্দিত ও উৎসাহিত। আমরা এই বৈঠককে সাধুবাদ জানাই। আর আমাদের যারা সম্ভাব্য প্রার্থী আছে তারা কাজ করছেন। এরপরে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তখন আমরা চেষ্টা করবো সমঝোতার ভিত্তিতে বিএনপি’র সঙ্গে মিলেই ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। আর নির্বাচনের প্রস্তুতি তো আমাদের আছেই।  
বিএনপির নেতৃত্বাধীন সমমনা জোটের নেতা এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ জানান, তার নির্বাচনি এলাকা নড়াইল-২-এ এখন প্রতিদিনই উঠান বৈঠক হচ্ছে। তিনি বলেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর নির্বাচনি প্রস্তুতিতে যেন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লন্ডন বৈঠকের পর ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিরোধীদের একটি মৌখিক সমঝোতা হয়েছে বলেই পরিস্খার বোঝা যাচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক সংঘাত আপাতত প্রশমিত এবং নির্বাচনমুখী ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে।

তবে লন্ডন বৈঠকের ওই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অখুশি জামায়াত এবং এনসিপি। কারণ বিএনপি এবং ড. ইউনূসের মধ্যকার এ ধরনের সমঝোতার বিষয়টি এই দল দুটির কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তারা বস্তুত এ মুহূর্তে নির্বাচন চাচ্ছিল না। নির্বাচন ছাড়াই তারা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। যদিও অনেক আগে থেকেই জামায়াত প্রার্থী ঘোষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না হলেও জামায়াতে ইসলামী প্রায় ৩০০ আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে ইতিমধ্যে। প্রচারণার কাজও শুরু করেছে বেশ আগে থেকেই। কিন্তু এগুলো অনেকটা আইওয়াশ।

এদিকে এনসিপি নামক নবগঠিত এ দলটি বরাবরই নির্বাচন বিরোধী কথাবার্তা বলে আসছে। তারা জানেন, আসন্ন নির্বাচনে নিজেরা মোটেই সুবিধা পারবেন না। নির্বাচন হলে এখনকার সুবিধাগুলো তাদের হারাতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি ঈদের আগে থেকেই সারা দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এখন দলটি কমিটি গোছানোয় মনোনিবেশ করছে। নির্বাচন হলে তারা অংশগ্রহণ করবে। এর আগে তারা জুলাই সনদ, সংস্কার ও বিচারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। 

অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এককভাবে এবং ইসলামী দলকে ঐক্যবদ্ধ করে জোটবদ্ধ উভয়ভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছে সংগঠনটি। এখন দলগুলো নিজ নিজ দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে। জোটবদ্ধ হওয়ার পরে সমঝোতার মাধ্যমে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবে। এদিকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নিজেদের ব্যানারে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংগঠনটির নেতারা অন্যান্য ইসলামী দল থেকে প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়বেন।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমেদ বলেন, নির্বাচনী প্রস্তুতি আমাদের আছে। প্রত্যেক শাখাকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক যে জোট গঠনের আলোচনা চলছে, এই জোটের সব দল নিজ নিজ দলের প্রার্থী ঘোষণা করবে। যখন ঐক্যবদ্ধ হবে তখন ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবে। 

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে কেউ নির্বাচনে অংশ নেবে না। তবে হেফাজতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে। তাদের সেই প্রস্তুতি রয়েছে। আর হেফাজতের কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তখন আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। 

বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনে যেতে চায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (নিবন্ধনবিহীন একাংশ)। দলটির সম্ভাব্য চার প্রার্থী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে দলটির মহাসচিব গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম জানিয়েছেন। নেজামে ইসলাম পার্টির (একাংশ) নির্বাহী সভাপতি মাওলানা একেএম আশরাফুল হক বলেন, আমরা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম। তবে আগামী নির্বাচনে আমরা ইসলামি সমমনা সম্ভাব্য জোট থেকে অংশ নিতে আগ্রহী। কারণ, ইসলামি শক্তিগুলো এক হলে ভালো হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে আগ্রহ থাকলেও ইসলামি সমমনাদের সঙ্গে এখনো কোনো যোগাযোগ হয়নি বলে জানান তিনি। 

শীর্ষনিউজ