Image description

আমাকে তারা আগে থেকেই ফরমেট সারারাত পড়াইছে, ‘এইটা এইটা বলবা। সকালবেলা আবার পড়াইসে, কোর্টে যাবা, যা যা জিজ্ঞাসা করুক, তুমি এটাই বলবা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।’

‘ম্যাজিস্ট্রেটকে আমি বলছি, স্যার, আমি একটু আপনার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই, ম্যাজিস্ট্রেটকে যখন আমি বলছি, স্যার, এগুলো আমি করিনি। এরা আমাকে মারধর করে, আমারে জোর করে এগুলো বলায় নিচ্ছে।’

‘ম্যাজিস্ট্রেট বলছেন, ঠিক আছে, আমি দেখতেছি। কিন্তু তারপরেও সে এটা আমার বিপক্ষে লেখছে। কারণ, এতদিন আমারে গুম রাখছে, অন্য কোনদিন কিন্তু তারা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আনতে পারতো না? (কিন্তু আসলে) যেদিন তাদের পছন্দের ম্যাজিস্ট্রেট ছিল, সেদিনই তারা আমারে কোর্টে হাজির করছে।’

১৯ বছর বয়সী এক যুবক গুম কমিশনের কাছে এভাবেই নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। ২০২০ সালে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) তাকে অপহরণ করে এবং ৪৪ দিন গুম করে রাখে।

তার মতো আরও অনেকে এভাবে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন গুম কমিশনের কাছে।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনের পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের আমলে গুম ও আটক হওয়া ব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে সরাসরি হুমকি, শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এসবের মধ্যে ছিল মৃত্যুর হুমকি, দীর্ঘমেয়াদি গুম, পরিবারের সদস্যদের ক্ষতির আশঙ্কা এবং বারবার নির্যাতন। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের বলা হতো, নির্ধারিত বক্তব্য না দিলে তাদের মেরে ফেলা হবে কিংবা আরও গুরুতর সাজানো মামলার শিকার হতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ভুক্তভোগীদের স্পষ্ট করে বলে দিতেন, তারা যদি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বাক্ষর না করেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নির্ধারিত বক্তব্য না দেন, তবে তাদের কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। বহুবিধ সাক্ষ্য বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ম্যাজিস্ট্রেটগণ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে কি না তা যাচাই করার জন্য যে ন্যূনতম আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, যারা তাদের নির্যাতন করেছে সেই কর্মকর্তারাই তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করেছেন এবং সেখানে তাদের স্বাধীনভাবে কথা বলার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। ওই সময়েই তাদের আবার রিমান্ডে পাঠানো হতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ম্যাজিস্ট্রেটরা এই বিষয়ে উদাসীন ছিলেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা বিশেষ করে আদালত ও প্রসিকিউশন রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন এবং রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা থেকে রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

মামলা পরিচালনার ধরন, আইনি বিকৃতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কমিশন বলছে, এই বিচার ব্যবস্থা তার মৌলিক দায়িত্ব অধিকার রক্ষা ও প্রক্রিয়াগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত থেকে সরে এসে রাজনৈতিক দমনকে বৈধতা দেওয়া এবং বিরোধীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেওয়া গুম কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।

 

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সোমবার (১৬ জুন) গুম কমিশনের প্রতিবেদনের কিছু অংশ গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য দেন।