Image description

বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক মতপ্রকাশ দমন এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করার এক সহায়ক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। বিচারপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে আইনগত বিকৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বিরোধীদের অপরাধী বানানো হতো, যা মৌলিক ন্যায়বিচারের চেতনার পরিপন্থি।

গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। সোমবার প্রতিবেদনটির কয়েকটি অধ্যায় সাংবাদিকদের দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, (হাসিনার জমানায়) আদালত ও প্রসিকিউশনের কাঠামো নাগরিক অধিকার রক্ষা এবং সুবিচার নিশ্চিত করার বদলে রাজনৈতিক নিপীড়নের জন্য ব্যবহৃত হতো। মামলার ধরন ও বিচার ব্যবস্থা আইনকে বিকৃত করার ফলে সাধারণ মানুষের আস্থা গিয়েছিল কমে।

দেশের বিভিন্ন জেলা বহু গুম ও জোরপূর্বক আটক ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা কমিশন বিশ্লেষণ করেছে। তাদের সাক্ষ্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে, স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য একটি সংগঠিত পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল, যা ভয়ভীতি, জোরপূর্বক চাপ ও আইনি প্রক্রিয়া লঙ্ঘনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো।

ভুক্তভোগীদের জানানো হতো, যদি তারা ‘১৬৪ ধারার’ আওতায় জবানবন্দি না দেয় বা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নির্ধারিত বক্তব্য না দেয়, তাহলে তাদের ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হবে। এই শাস্তি হিসেবে সরাসরি হত্যার হুমকি, দীর্ঘদিন গুম রাখা, পরিবারের ওপর হুমকি বা মিথ্যা মামলা দায়েরের ভয় সৃষ্টি করা হয়।

ভুক্তভোগী এক ব্যক্তি জানান, ‘আমাকে সারা রাত ধরে রেখে বলেছে, তুমি যদি স্বীকারোক্তি না দাও, তাহলে তোমার স্ত্রীকে নিয়ে আসব, তাকে মেরেই ফেলব। এখানে কোনো পুলিশ নেই, কেউ কিছু করতে পারবে না।’

আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘চার মাস আটক থাকার পর একদিন চোখ বেঁধে নিয়ে আমাকে বলল, তুমি কি এখান থেকে বের হতে চাও? যদি বলো, তাহলে আমরা যা বলব, তুমি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাই বলবে। না হলে তোমাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলব।’

কমিশন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এ ধরনের বিচারব্যবস্থার অপব্যবহার দীর্ঘদিন চলতে থাকলে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ এবং আইনের শাসন দুর্বল হবে। তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যাতে বিচার ব্যবস্থা তার ন্যায়বিচারের আদর্শে ফিরে আসতে পারে এবং কারো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষিত হয়।

অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা আইনজীবী ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতেন এবং কোনো আইনি পরামর্শ না নিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হন, যা প্রক্রিয়াগত সুরক্ষা নষ্ট করে।

‘জজ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের কোনো উকিল আছে?’ আমরা তো ধরেই আনা হয়েছিলাম, উকিল ধরার সুযোগই ছিল না। বললাম, ‘উকিল নেই।’ তখন চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলো।”

‘রিমান্ড চাইতে আসার আগের দিনই আটক করা হয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘তোমরা তো ডিটেনি পারসন, তাহলে কেন আগের দিন গ্রেফতার দেখানো হলো?’ পুলিশ বলল, ‘ওরা ট্রেনিংপ্রাপ্ত, তাই বলতে পারল।’ অথচ আমাদের মুখ কেটে, পোশাক পাল্টে মিডিয়ায় দেখানো হয়েছিল।’

কমিশন হুঁশিয়ারি দিয়েছে, বিচারব্যবস্থার এমন অপব্যবহার যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আইনের শাসন ও নাগরিক অধিকারের ভিত্তি দুর্বল হবে এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন অবৈধভাবে বৈধতা পাবে। ফলে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য এটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।

বিচারিক নিষ্ক্রিয়তা ও সহযোগিতা: একাধিক ভুক্তভোগীর বক্তব্য থেকে দেখা গেছে, ম্যাজিস্ট্রেটরা স্বীকারোক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া যাচাই-বাছাই করেননি। বরং নির্যাতনকারী সংস্থাগুলো ভুক্তভোগীদের সরাসরি আদালতে হাজির করিয়ে রিমান্ড মঞ্জুর করে নিয়েছেন, যেখানে আসামিদের কথা বলার সুযোগই দেওয়া হয়নি। অনেক জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেটরা কেবল স্বাক্ষর নেওয়ার কাজ করেছেন, তদন্ত বা জবাবদিহিতার সুযোগ ছাড়াই।

‘আমি বললাম, স্যার, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তারা আমাকে ডিটেন করে রেখেছিল। স্যার, আমি কিছু জানি না। তখন উনি অনেক কথা কেটে দিলেন, বললেন, ‘আর কাটা যাবে না, সাইন করো।’ আমি অনুরোধ করেও কোনো সুযোগ পাইনি।’

‘১৬৪ ধারায় জোর করে স্বীকারোক্তি করানো হলো। ম্যাজিস্ট্রেট প্রশ্ন করছেন, আমি উত্তর দিচ্ছি, আর তিনি নিজের মতো করে টাইপ করছেন। আমি বলেছি লাইব্রেরি ছিল, কিন্তু তিনি লিখেছেন আমি জিহাদি কার্যক্রমে জড়িত ছিলাম, যা আমি কখনো বলিনি।’

‘আমি বললাম, আমাকে সদরঘাট থেকে ধরে এনেছে, মারধর করেছে। ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘তোমার নাম তো এজহারে আছে, রিমান্ড দিতে হবে।’ আমি বললাম, এতদিন র‍্যাবের হেফাজতে ছিলাম। উনি বললেন, ‘র‍্যাব অফিসে ছিলেন? তাহলে রিমান্ড দিতে হবে।’ এবং তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেন।’

এই ঘটনাগুলো শুধুমাত্র বিচারিক ত্রুটি নয়, বরং একটি সিস্টেমেটিক নির্যাতনের ছবি ফুটিয়ে তোলে। জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ে হুমকি, পূর্বনির্ধারিত বক্তব্য মুখস্থ করানো, আইনজীবীর অনুপস্থিতি এবং বিচারকদের নিষ্ক্রিয়তা বা যোগসাজশ- এসব মিলিয়ে একটি সংকটজনক চক্র তৈরি হয়েছে, যা বলপূর্বক ও অবৈধ স্বীকারোক্তিকে ‘আইনসম্মত’ রূপ দেয়ার পথ সুগম করছে।

কমিশনের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনের আওতায়, যেখানে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে- মোট ১৯৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা। এর পরেই রয়েছে ১৮৮৪ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইন (৫১ জন) ও ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন (৪৩ জন)।

এখান থেকে স্পষ্ট যে, বিচার ব্যবস্থায় জাতীয় নিরাপত্তা ও ফৌজদারি আইনগুলোর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা একটি কাঠামোগত অপরাধীকরণের প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে ব্যক্তিগত প্রমাণের বদলে সাধারণীকৃত দমনমূলক নীতি

তথ্য বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, অপহরণের সাল, ভুক্তভোগীর পেশা কিংবা বয়স নির্বিশেষে সবাইকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’ এর আওতায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই অভিন্নতা প্রমাণ করে, এসব মামলা ব্যক্তি নির্দিষ্ট তদন্ত বা অভিযোগের ফল নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে ভিন্নমত ও বিরোধী পক্ষকে দমন করাই মূল উদ্দেশ্য। একজন ছাত্র হোক বা ব্যবসায়ী, ২০১২ সালের ঘটনা হোক বা ২০২২ সালের- সব ক্ষেত্রেই একই আইনের প্রয়োগের এই প্রবণতা স্পষ্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনার দৃষ্টান্ত।

অভিযোগপত্রের ‘স্ক্রিপ্টেড’ ভাষা; বিচারবহির্ভূত এক অভ্যাস: সরকারি কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ফৌজদারি আইনের আওতায় গঠিত অভিযোগপত্রগুলো সময়, স্থান ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্বিশেষে প্রায় একই রকম দেখা যায়। অপরিষ্কার ভাষা, পুনরাবৃত্ত অভিযোগ এবং কৃত্রিমভাবে সাজানো ব্যাখ্যা এসব অভিযোগের বৈশিষ্ট্য। এতে প্রমাণ যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং মতপ্রকাশ, প্রতিবাদ ও আদর্শগত ভিন্নমতকে ‘জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

একাধিক থানায়, বিভিন্ন ব্যক্তি ও ঘটনাকে একই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ভাষায় বর্ণনা করে মামলা দায়েরের পেছনে বিচারের কোনো পৃথক তদন্ত নেই। অভিযোগপত্রগুলো যেন একটি ফরমায়েশি খসড়ার আদলে তৈরি, যা আইনগত প্রক্রিয়াকে বাইপাস করে এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি জোরদার করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় মামলাগুলোতে ‘গোপন গোয়েন্দা তথ্য’ ব্যবহারের ব্যাপকতা বেড়েছে। পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায়শই আপাত গোপন সূত্রের ওপর ভিত্তি করে অভিযান চালান, কিন্তু এই তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়মিত প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশি অভিযোগপত্রে ‘গোপন গোয়েন্দা তথ্য’ উল্লেখ থাকলেও নির্দিষ্ট প্রমাণের অভাব চোখে পড়ে। যেমন, ২০১৪ সালে সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে থানায় ‘টহল চলাকালে গোপন সূত্রে জানা’ ও ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানায় ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপস্থিতি শনাক্ত’ হওয়ার অভিযোগ দেখা গেছে। অন্য জেলার থানাগুলোতেও অনুরূপ তথ্যভিত্তিক অভিযানের বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে অভিযানের সুষ্ঠু প্রমাণ প্রদর্শনে ব্যর্থতা স্পষ্ট।

পুলিশি অভিযোগপত্রে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য ‘পালানোর চেষ্টা’ একটি অভিন্ন অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৬ সালের আকবর শাহ থানায় “টহলদল দেখে পালানোর চেষ্টা” করার তথ্যসহ, ২০১৭ সালে ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ ও নন্দীগ্রামে অভিযুক্তদের পালানোর অভিযোগ প্রায় একই রকম ভাষায় রয়েছে। এই ধরনের ‘পালানোর চেষ্টা’ সংক্রান্ত অভিযোগ মামলার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও প্রায়শই গ্রেপ্তারের জন্য ব্যবহৃত চাপানো বক্তব্য বলে মনে করা হয়।

গ্রেপ্তারের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে “দ্রুত স্বীকারোক্তি” পাওয়া যায়, যা বাস্তবিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অবাস্তব বলে অভিযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সিরাজগঞ্জে ২০১৪ সালে অভিযুক্তরা জেএমবি’র সক্রিয় সদস্য হওয়ার স্বীকারোক্তি দেন। একইভাবে ২০১৬ সালের আকবর শাহ থানায় হারকাতুল জিহাদ আল-ইসলামীর সদস্যপদ স্বীকার করা হয়। নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা ও টঙ্গি পশ্চিমসহ বিভিন্ন এলাকায় স্বীকারোক্তির এই প্রবণতা লক্ষণীয়।

আদালতে এই স্বীকারোক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন অভিযুক্তের কাছ থেকে প্রচুর ইসলামি ও জিহাদী গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের উল্লেখ পাওয়া যায়। সিরাজগঞ্জে ৪৭টি ইসলামি ও জিহাদি বই, আকবর শাহ থানায় ১৪টি জিহাদি গ্রন্থের তালিকা অভিযোগপত্রে উল্লিখিত। নারায়ণগঞ্জ, ক্যান্টোনমেন্ট, গাজীপুর ও টঙ্গি থানাগুলোর মামলাতেও একইরকম গ্রন্থের উপস্থিতি “সন্ত্রাসী মনোভাবের প্রমাণ” হিসেবে তুলে ধরা হয়। এ ধরনের বইয়ের উপস্থিতিকে প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড অভিযোগের অংশ হিসেবে দেখা হয়, যা আইনি প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত দেয়।

এসব অভিযোগপত্রে ‘গোপন গোয়েন্দা তথ্য’ এর প্রতি অগাধ বিশ্বাস, ‘পালানোর চেষ্টা’ কে গ্রেপ্তারের অজুহাত এবং স্বীকারোক্তির অস্বাভাবিক দ্রুততা যেন আইনি প্রক্রিয়াকে কার্যত পেছনে ফেলে দিয়ে একটি প্রি-স্ক্রিপ্টেড এবং স্বার্থান্বেষী বিচার ব্যবস্থার ছবি আঁকছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক বছরে দেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোতে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তির ‘স্ক্রিপ্ট’ বা প্রস্তুত চিত্রনাট্য ব্যবহার ব্যাপক মাত্রায় দেখা গেছে। একাধিক পুলিশের কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় জানা গেছে, বিভিন্ন মামলার জন্য পূর্বনির্ধারিত ‘টেমপ্লেট’ ব্যবহার করা হয়। নতুন মামলায় সেই পুরোনো স্ক্রিপ্ট সামান্য পরিবর্তন বা সরাসরি কপি-পেস্ট করে অভিযুক্তের নামে বসানো হয়। এতে অভিযোগপত্রে স্ববিরোধিতা, দুর্বল বর্ণনা এবং পর্যাপ্ত অনুসন্ধানের অভাব লক্ষ্য করা যায়।

এই প্রক্রিয়াটি বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতার বিপরীতে একটি আদর্শগত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার প্রতিফলন, যেখানে তথ্যের নির্ভুলতার চেয়ে রাজনৈতিক বর্ণনা প্রবল হয়। যাচাই-বাছাইহীন গোয়েন্দা তথ্য ও পূর্বনির্ধারিত স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে ‘সম্পর্ক থাকলেই দোষী’– এমন ভুল ধারণার ওপর মামলা দাঁড় করানো হয়। এর ফলে আইন ব্যবস্থায় বসে ‘দোষ স্বীকারের সাজানো চিত্রনাট্য’ যা সুবিচারের পরিবর্তে বিচার ব্যবস্থায় প্রশ্নবিদ্ধতা সৃষ্টি করে।

আদালতের ওপর প্রভাব ও বিচার ব্যবস্থার সংকট: ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার এক প্রকার দমনমূলক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে দেখা গেছে। ২০১৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের ৭৯৪টি মামলা বিশ্লেষণে প্রকাশ পায়, কেবলমাত্র ৫২টিতে দণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ, মাত্র ৭% সাজাপ্রাপ্তি এবং ৯৩% মামলা খালাস- যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইচ্ছেমতো মামলা সাজানোর সুযোগ পায়।

খালাসের এই অত্যধিক হার দেখায়, এসব মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রমাণের মান সন্দেহাতীতভাবে দুর্বল ছিল। যদিও খালাসপ্রাপ্তরা সামাজিক সম্মান ফিরে পান, ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে একবার অভিযুক্ত হওয়া তাদের ওপর আজীবন কলঙ্ক স্বরূপ হয়ে থাকে। এই পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োগ ন্যায্য বিচারের চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বেশি প্রভাবিত হয়ে উঠেছিলো। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের বিচারাধীন মামলার বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার থেকে উঠে এসেছে, কীভাবে এই আইন ব্যবহার হয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের একটি হাতিয়ার হয়ে গেছে।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলো ও তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে মামলা দায়ের করা হয়। ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের প্রতিবাদে বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ২০২২ সালে বিএনপি ও জামায়াতের সংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে নিয়মিত মামলা দায়ের অব্যাহত ছিল। ২০২৩ সালে রাজপথের আন্দোলনে মনোযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের হ্রাস পায়। ২০২৪ সালে মামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে, যা জাতীয় নির্বাচনের পর বিরোধী দলগুলোর স্থবিরতা প্রতিফলিত করে। এ তথ্য প্রমাণ করে, এসব মামলা নিছক সন্ত্রাসবিরোধী নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজানো।

বিচার বিভাগের পারফরম্যান্স সূচক হিসেবে ‘পাঁচ বছর ধরে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা’ ব্যবহৃত হয়। ২০২২ সালে ২০১৭-১৮ সালের মামলার ঢল কমানোর জন্য অনেক মামলার নিষ্পত্তি করা হয়। একজন বিচারক জানান, “নতুন মামলা কিছু সময়ের জন্য স্থগিত রেখে, পাঁচ বছর পার হওয়া মামলা আগে নিষ্পত্তি করি।” এটি ইঙ্গিত দেয় যে প্রশাসনিক চাপের কারণে প্রকৃত বিচার না করে মামলা শেষের চেষ্টা করা হয়।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ সময় মামলা ঝুলিয়ে রাখার উদ্দেশ্য মূলত রাষ্ট্রীয় হয়রানি। অনেক সময় বলা হয়, ‘তোমাকে মুক্তি দেওয়া হবে, কিন্তু একটা প্রক্রিয়া আছে।’ এই প্রক্রিয়া মানে হলো- প্রথমে মিডিয়ায় তুলে ধরা, তারপর মিথ্যা মামলা, কয়েক মাস জেল খাটা এবং শেষ পর্যন্ত জামিন। এই প্রক্রিয়া অনেকের জীবন ও মানসিকতায় স্থায়ী ক্ষতি করেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, একটি মামলার গড় খরচ প্রায় ৭ লাখ টাকা, যা দেশের গড় পরিবারের দুই থেকে পাঁচ বছরের আয় সমান। অনেক পরিবার বাড়িঘর বিক্রি করে, ঋণ নেয় বা দীর্ঘ দেনায় জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত হয় দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক দুর্দশা। নিয়মিত আদালতে হাজিরা, দূর দূরান্তে যাতায়াত এবং মামলার চাপ মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।