
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে দেশে অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে জর্জরিত আওয়ামী লীগের দেড় দশকের বেশি সময়ের শাসনের অবসান ঘটেছে। সেইসঙ্গে দেশের সব সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে নীতিনির্ধারণী জায়গায় পরিবর্তন আসে। এরই ধারাবাহিতকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেওয়া নতুন প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়টির নানা উদ্যোগ ও সংস্কারে হাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে কমিটি করা হয় একাধিক। তবে ১০ মাস পর এসেও এসব কমিটির নেই কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ। ফলে এসব উদ্যোগ ও সংস্কার কমিটিতেই আটকা পড়ছে।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ডাকসু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হলেও ১০ মাস পরও তার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখতে পায়নি। পাশাপাশি জুলাইয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়া ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিচার এবং গণহত্যার মদদদাতা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মতো মৌলিক কাজে নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ-সংস্কার।
তারা মনে করেন, সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীরা এই প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট, এমনটা বলার সুযোগ নেই। বরং দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ ও সংস্কার না থাকাটা দুঃখজনক ও একইসঙ্গে প্রশাসনের ব্যর্থতা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, আইনি প্রক্রিয়া যথাযথ মেনে কমিটি কাজ করছে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আইনের দৃষ্টিতে যেন হীতে বিপরীত না হয়, সেটাও বিবেচনা করা হচ্ছে। আর গঠিত সব কমিটিতে থাকা শিক্ষকদের একাডেমিক কাজের পাশাপাশি এসব কাজও করতে হচ্ছে। ফলে তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। তাছাড়া, কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা ও তথ্য পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, আইনি প্রক্রিয়া যথাযথ মেনে কমিটি কাজ করছে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আইনের দৃষ্টিতে যেন হীতে বিপরীত না হয়, সেটাও বিবেচনা করা হচ্ছে। আর গঠিত সব কমিটিতে থাকা শিক্ষকদের একাডেমিক কাজের পাশাপাশি এসব কাজও করতে হচ্ছে। ফলে তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। তাছাড়া, কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা ও তথ্য পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ২৮ আগস্ট শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদকে প্রক্টর, ২৯ আগস্ট ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে কোষাধ্যক্ষ, ২ সেপ্টেম্বর অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশাকে প্রো-ভিসি (প্রশাসন), ১২ সেপ্টেম্বর প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মামুন আহমেদকে প্রো-ভিসি (শিক্ষা) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ ও আবাসিক হলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও নতুন মুখ দেখা যায়।
শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার অন্তরে লালিত ফ্যাসিস্ট আমলের বিভিন্ন অসম রীতি-নীতির পরিবর্তন; দুর্নীতিবাজ, অপরাধী ও দুর্বৃত্তায়ণের চর্চাকারী আওয়ামীপন্থি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ছাত্রসংসদ অর্থাৎ ডাকসু নির্বাচন, বিগত শাসনামলে বঞ্চিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণসহ বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন এখনো অধরা।
তাদের কাছে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার অন্তরে লালিত ফ্যাসিস্ট আমলের বিভিন্ন অসম রীতি-নীতির পরিবর্তন; দুর্নীতিবাজ, অপরাধী ও দুর্বৃত্তায়ণের চর্চাকারী আওয়ামীপন্থি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ছাত্রসংসদ অর্থাৎ ডাকসু নির্বাচন, বিগত শাসনামলে বঞ্চিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণসহ বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন এখনো অধরা।
তাছাড়াও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ও গবেষণা কার্যক্রম উন্নয়ন, শিক্ষক নিয়োগ, অন্ধ দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির সংস্কারমূলক পরিবর্তন, আবাসন সংকট নিরসনসহ নানা ইস্যুতেই বিশ্ববিদ্যালয় এখনো নীরব দর্শকের ভূমিকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে ডাকসু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয় এবং জানুয়ারিতে ‘ডাকসু ইলেকশন কোড অব কনডাক্ট রিভিউ কমিটি’ গঠন করা হয়। এরপর চলতি বছরের এপ্রিলে রোডম্যাপ ঘোষণা ও রোডম্যাপ অনুযায়ী মে মাসে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা, রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার কথা থাকলেও অদৃশ্য কারণে তা থমকে আছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, অনশন ও অবস্থান কর্মসূচি এবং স্মারকলিপি প্রদানের মত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
যদিও গত ২ জুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে ৬ষ্ঠ ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা এখনও চলমান রয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় সাময়িকভাবে বৈঠকে স্থবিরতা দেখা দিলেও নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর হামলা ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী সকলের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যদিও ১২৮ জনের একটা তালিকা প্রকাশ করে তাদেরকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এ তালিকার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, কারণ তালিকায় থাকা ৬জন ঢাবিরই শিক্ষার্থী নয়। এছাড়া, হামলায় জড়িত অধিকাংশের নামই এ তালিকায় আসেনি বলে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ব্যর্থতার দরুন গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হামলার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে গত ১৭ এপ্রিল ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি ছায়া তদন্ত কমিটি গঠন করেন একদল শিক্ষার্থী। এদিকে, গত ১৭ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় ২৮৯ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করলেও হামলাকারীদের শাস্তি নিশ্চিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এমনকি প্রশাসনিক সহায়তায় কোনো কোনো ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
তাছাড়া, আওয়ামী লীগের আমলে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের কর্মসূচি, কাওয়ালী গানের আসর, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্রদল, ছাত্রশক্তি ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের বর্বর হামলা এবং গেস্টরুম নির্যাতনসহ সংগঠনটির নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক উদ্যোগ বা অগ্রগতি দেখা যায়নি।
আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। এছাড়াও কোনো কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অপেশাদার আচরণ এবং হিজাব ও ধর্ম অবমাননাসহ বিভিন্ন অভিযোগের কারণে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে অর্ধশতাধিক শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন। এ প্রেক্ষিতে কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে দেখা গেলেও অধিকাংশ অভিযুক্তদের ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল নেতা অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভুঁইয়া, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জিনাত হুদা, সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মশিউর রহমান, অধ্যাপক জামাল উদ্দিন, অধ্যাপক সাদেকা হালিম, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল বাছির, অধ্যাপক মো. আবদুর রহিম, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও নীল দলের আহ্বায়ক ড. এ. এম. আমজাদ, মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মিজানুর রহমান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম অহিদুজ্জামান চাঁন, অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ওরফে লিটুসহ অনেক ‘আওয়ামীপন্থি’ শিক্ষকদের (যাদেরকে অনেকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলে থাকেন) বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অফিসে কর্মরত শতাধিক কর্মকর্তা জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা করা এবং আওয়ামী লীগের দোসর হওয়া সত্ত্বেও তাদের ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তাদের মধ্যকার কিছু কর্মকর্তাকে শুধুমাত্র বদলি করে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫-৪০ জন কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকারের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে প্রশাসনিক ভবনেই মিছিল করেছিলেন।
আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট যখন দেশজুড়ে উত্তাল পরিস্থিতি ও স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের মাত্র একদিন বাকি, সেদিনও স্বৈরাচারকে টিকিয়ে রাখতে ৩৫ থেকে ৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশাসনিক ভবনেই মিছিল করেছিলেন। সেসময় যারা তাদের মিছিলে যোগ দেয়নি, তাদের দেখে নেওয়ার হুমকিও দেয়া হয়েছিল। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন তাদেরকে শাস্তির আওতায় না এনে কাউকে কাউকে শুধু বদলি করে দায়মুক্ত হয়েছে।
৫ আগস্ট পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটেছে। যা ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতা হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ১৩ মে রাত ১১টার পর শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে শাহরিয়ার আলম সাম্য নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এর আগে, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করে হলটির কয়েকজন শিক্ষার্থী। এসময় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বারবার অবহিত করা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ত ভূমিকার কারণে তোফাজ্জলের প্রাণ হারাতে হয়। যদিও পরে এ হত্যার ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে অভিযুক্ত আট ছাত্রের আবাসিক সিট ব্যতিল করে হল প্রশাসন। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সাময়িকভাবে বহিষ্কারের আদেশ দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে (২০০৯–২০২৪) দুই হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্র অনুযায়ী, অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক উপাচার্য থাকাকালে (২০০৯–২০১৭) সবচেয়ে বেশি নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়, যার সংখ্যা প্রায় ১,৩৪৬ জন। পরবর্তী সাত বছরে (২০১৭–২০২৪) নিয়োগ ও পদোন্নতির সংখ্যা ৮৫০ এর বেশি। সব মিলিয়ে ১৫ বছরে মোট নিয়োগ-পদোন্নতির সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ১৯৬ জনে। এসব নিয়োগ ও পদোন্নতির পেছনে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ উঠেছে। অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান প্রশাসন এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম তদন্তে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করলেও এর কার্যক্রম ধীর গতিতে চলছে বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যেমন শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশা করেছিলো তা পূরণ করতে পারেনি ঢাবি প্রশাসন। সিট সমস্যার যতটুকু সমাধান হয়েছে তার ক্রেডিট শিক্ষার্থীদের নিজেদের। প্রশাসন একাডেমিক থেকে আবাসন, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য কোন ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে আন্তরিকতা দেখাচ্ছে না। ছাত্রলীগের রেখে যাওয়া অনেক শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে আছেন। ছাত্র সংসদ নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীরা এই প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট, এমনটা বলার সুযোগ নেই।
দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী নওশিন নাহার অথি বলেন, বর্তমান প্রশাসনের সময় ক্যাম্পাসে দুটি খুন হয়েছে যার দায় তারা কোনোভাবে এড়াতে পারে না। ভিন্ন মত হওয়ায় আওয়ামীপন্থি শিক্ষকেরা অনেক শিক্ষার্থীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন অতীতে, সেসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ক্যাম্পাসের বাইরে নারীদের দুটো হল নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। যাতায়াত সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতা, খাবারের মান ভালো না, একটু বৃষ্টি হলেই হলের রুম পর্যন্ত পানিতে ডুবে যায়। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে কাজ করতে না পারা প্রশাসনের ব্যর্থতা।
বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রধান দায়িত্ব হওয়া দরকার ছিল- ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিচার এবং গণহত্যার মদদদাতা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এরপরে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল শিক্ষার কার্যক্রম সঁচল করাসহ অন্যান্য কাজে। মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে তাদের এমন ঢিলেমি দুঃখজনক। তারা ছাত্রলীগের বিচার করবে তো দূরের কথা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরকে সহযোগিতা করার ঘটনাও ঘটেছে।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মাদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রধান দায়িত্ব হওয়া দরকার ছিল- ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিচার এবং গণহত্যার মদদদাতা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এরপরে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল শিক্ষার কার্যক্রম সঁচল করাসহ অন্যান্য কাজে। মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে তাদের এমন ঢিলেমি দুঃখজনক। তারা ছাত্রলীগের বিচার করবে তো দূরের কথা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরকে সহযোগিতা করার ঘটনাও ঘটেছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে এই আহ্বান জানাবো যে, আপনারা অবিলম্বে তালবাহানা বন্ধ করুন এবং ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়ে বলেন, আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্ধ দলীয় রাজনীতি আগের মত থাকবে না এবং দলীয় ছাত্ররাজনীতি থাকবে না। আবাসিক হলে হলে ব্যানার টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয় কোন দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি থাকবে না, সেই বিষয়টি ধরে রাখতে স্পষ্ট কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছেনা। আমি আশা করেছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দলীয়ভাবে হবে না, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় সেভাবে হবে। শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রমোশন নীতিমালার আমূল পরিবর্তন হবে এমনটা আমি ভেবেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট ডক্টরাল পজিশন আসবে; স্ট্রং পিএইচডি প্রোগ্রাম আসবে; শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা শতভাগ নিশ্চিত হবে; কোনো শিক্ষার্থী গণরুমে থাকবে না; কেউ নির্যাতনের স্বীকার হবেনা; দলীয় রেষারেষি হবে না, কোনো হল কোনো শিক্ষক চালাবে না, হল চালাবে কর্মকর্তারা, শিক্ষকরা শিক্ষা কার্যক্রম ও গবেষণায় ব্যস্ত থাকবে এবং তখন হোটেল ম্যানেজমেন্টের মত হল পরিচালনা করতে হতো না, যারা বিভিন্ন সময়ে অন্যায় করেছে তারা শাস্তির মুখোমুখি হবে, এগুলো আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল।
তিনি বলেন, কীভাবে ঝামেলা ছাড়া ডাকসুর আয়োজন করা যায়, কীভাবে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি করা যায়, সে চিন্তা করতে হবে। ছাত্ররা যেন ছাত্রকেন্দ্রিক রাজনীতি করে। দূষণমুক্ত ও পরিষ্কার ক্যাম্পাসে রূপ দেওয়া, প্রতি ফ্যাকাল্টিতে লেকচার থিয়েটার করা, বিভাগগুলোর জন্য কমন একটা জায়গা করা যেখানে গবেষণাগার, লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া, ইনডোর প্লে-গ্রাউন্ডসহ বিভিন্ন ফ্যাসিলিটিজের সমন্বয় থাকবে। এসবের ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে।
আমরা বিভিন্ন কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাচ্ছি না। যেমন, ছাত্রলীগের হামলার জড়িতদের চিহ্নিত করার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে প্রমাণ সরবরাহ করতে বলা হলেও আমরা তেমন সাড়া পাচ্ছি না। আর এসব বিষয়গুলো তদন্ত চলমান রয়েছে। তাছাড়া আমরা যারা কমিটিতে আছি তাদের একাডেমিক, প্রশাসনিক কার্যক্রমও পরিচালনা করতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকা কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান খান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা বিভিন্ন কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাচ্ছি না। যেমন, ছাত্রলীগের হামলার জড়িতদের চিহ্নিত করার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে প্রমাণ সরবরাহ করতে বলা হলেও আমরা তেমন সাড়া পাচ্ছি না। আর এসব বিষয়গুলো তদন্ত চলমান রয়েছে। তাছাড়া আমরা যারা কমিটিতে আছি তাদের একাডেমিক, প্রশাসনিক কার্যক্রমও পরিচালনা করতে হয়। এজন্যই এসব কমিটির বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে সময়টা একটু বেশি লাগে। তবে এসব কমিটির কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, উপাচার্য স্যার চাচ্ছেন যেকোনো বিষয়ে আইনগত সঠিক পদ্ধতিতে এগিয়ে যেতে। আমরা বিভিন্ন সময় দেখি প্রশাসনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে আইনের ফাঁকফোকর থাকে। পরবর্তীতে আদালতে মামলার কাছে হেরে যাই। তাই আমরা এমনভাবে আগাতে চাচ্ছি যেন পরবর্তীতে আর কোন আইনি ঝামেলায় পড়তে না হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জনপ্রত্যাশা অসীম। কিন্তু সবকিছু আমাদের একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সেজন্য একটু সময় লাগছে। তবে বিভিন্ন কমিটি তাদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে।
তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ড ও সাম্য হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ায় কমিটি যত দ্রুত কাজ করেছে, আমার মনে হয় না অন্য কোন প্রশাসন এমন দ্রুত কাজ করতে পেরেছে। ছাত্রলীগের হামলার জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সরবরাহ করার ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। আমরা তেমন কোন সাড়া পাইনি। পরবর্তীতে আবারো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এখন এসব ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা কাম্য।
প্রক্টর আরও বলেন, তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ড ও সাম্য হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ায় কমিটি যত দ্রুত কাজ করেছে, আমার মনে হয় না অন্য কোন প্রশাসন এমন দ্রুত কাজ করতে পেরেছে। ছাত্রলীগের হামলার জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সরবরাহ করার ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। আমরা তেমন কোন সাড়া পাইনি। পরবর্তীতে আবারো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এখন এসব ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা কাম্য।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিটিগুলোতে যারা আছেন তারা একাধারে একাধিক কমিটিতে থাকেন। যেমন এই কমিটিগুলোতে একজন অনুষদের ডিন থাকে, সেই সাথে একজন সহকারী প্রক্টর, আইনের লোকসহ কয়েকজনকে নিয়ে এসব কমিটি গঠন করা হয়। তারা তাদের একাডেমিক কাজ শেষ করে পরবর্তী এসব বিষয়ে নজর দেন। তাছাড়া আমরা সব বিষয়ে আইনগত দিক মেনে কাজ করছি। যেহেতু আইনি প্রক্রিয়া একটু সময় সাপেক্ষ। তাই এসব বিষয়ে কাজ হচ্ছে তবে একটু ধীর গতিতে। আমরা চাই, সবকিছু আইনগত দিক মেনে করা হোক যেন পরবর্তীতে কোন ঝামেলা না হয়।
বিভিন্ন কমিটির অগ্রগতির বিষয়ে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) বলেন, আমরা সার্বিক বিষয়ে বিভিন্ন কমিটি গঠন করেছি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছি। এগুলো সম্পন্ন করতে হয়তো সময় লাগবে। তবে যখন এসব বিষয়ে ফল দেখতে পাবেন তখন সবকিছু আপনারাই বুঝতে পারবেন।