
দখলদার ইসরাইলের নতুন করে ইরানে চালানো আগ্রাসন বাংলাদেশকেও সংকটের মধ্যে ফেলবে। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে গেছে, অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে এলএনজি আমদানিতে। বাংলাদেশ কাতার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে মূলত হরমুজ প্রণালি দিয়ে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি রপ্তানির পথ এই হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি বিবেচনা করছে ইরান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে শুধু জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এতে বাংলাদেশসহ জ্বালানি আমদানিনির্ভর সব দেশই বড় সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ হরমুজ প্রণালি। ইরানের উপকূলঘেঁষা সরু এ চ্যানেল সংযুক্ত করেছে জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ পারস্য উপসাগর ও আরব সাগরকে।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন ও ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানির প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে এ পথের ওপর। ওমান ও ইরানের মধ্যবর্তী গুরুত্বপূর্ণ এ সামুদ্রিক পথ দিয়ে দৈনিক দেড় কোটি ঘনমিটারের মতো এলএনজি পরিবাহিত হয় বলে ইন্টারন্যাশনাল গ্যাস ইউনিয়নের (আইজিইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে এ পথ ব্যবহার করে।
গত ১২ জুন ইসরাইলের আক্রমণে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে তেলের দাম ৭ থেকে ১১ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বর্তমানে ব্যারেলপ্রতি ৭৪ দশমিক ৫৬ মার্কিন ডলার এবং ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ব্যারেলপ্রতি ৭০ দশমিক ৩৭ ডলারে অবস্থান করছে।
ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের জন্য একটি বড় হুমকি হতে পারে। এ প্রণালি দিয়ে দৈনিক প্রায় ১৮-১৯ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়, যা বিশ্বের মোট চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ। যদি এটি বন্ধ হয় তাহলে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে, যা বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়াবে।
এদিকে ইরানে ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সোনার দামও ১ শতাংশের বেশি বেড়েছে এবং ডলার শক্তিশালী হয়েছে।
অন্যদিকে স্টক মার্কেটের সূচকগুলো নিম্নমুখী হয়েছে। যেমন- ডাও জোন্স শিল্প সূচক ৮০০ পয়েন্ট কমেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্টক সূচক, যা ৩০টি বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শেয়ারের গড় মূল্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। এ সূচক বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জেপি মর্গান পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার-আদর্শ ব্রেন্টের দাম গড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৩ মার্কিন ডলার হতে পারে। তবে সরবরাহ সংকট বা ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে তা ১৫০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে।
রপ্তানি খাতের সংকট, জ্বালানিব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ে কাজ করেন তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি আমার দেশকে জানান, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে তেলের দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে। ইরান ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি জ্বালানি তেলের চুক্তি না থাকায় আমাদের প্রধান সরবরাহ উৎস মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক বাজার। তেলের দাম বাড়লে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, যা ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াতে পারে।
বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করে মার্কেট ওয়াচ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এ ভূরাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্টক মার্কেটগুলোয় বড় ধরনের পতন দেখা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণ ও ডলারের মতো নিরাপদ সম্পদের দিকে ঝুঁকছেন। এ ধাক্কা দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বর্তমানে কাতার ও ওমানের দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা কাতার এনার্জির সঙ্গে দুটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে। প্রথম চুক্তির আওতায় ১৫ বছরের জন্য বার্ষিক ২৫ লাখ টন এলএনজি সরবরাহ হবে বাংলাদেশে। দ্বিতীয় চুক্তিও ১৫ বছর মেয়াদি, যার আওতায় কাতার এনার্জির এলএনজি ট্রেডিং শাখার মাধ্যমে বার্ষিক ১৮ লাখ টন এলএনজি সরবরাহ হবে।
অন্যদিকে ওমানের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ওকিউ ট্রেডিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের পেট্রোবাংলার দুটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে। এর একটি ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের (বর্তমানে ওকিউ ট্রেডিং) মাধ্যমে ১০ বছরের জন্য বার্ষিক ১০ লাখ টন এলএনজি সরবরাহের চুক্তি। দ্বিতীয়টি ওকিউ ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে ১০ বছরের জন্য বার্ষিক আড়াই লাখ থেকে ১৫ লাখ টন এলএনজি সরবরাহের চুক্তি।
এলএনজি আমদানির বিষয়টি দেখভাল করে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির সাবসিডিয়ারি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, কাতার গ্যাসের কাছ থেকে চলতি অর্থবছরে মোট ৪০ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত ৩৪টি কার্গো দেশে এসেছে। সংশ্লিষ্ট কার্গো আমদানির মাধ্যমে কাতার থেকে দুই হাজার ৯৩ মিলিয়ন টন এলএনজি দেশে এসেছে। বাকি কার্গো আমদানির কার্যক্রম চলমান।
দেশের শিল্প খাতেই এলএনজির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তাই এ জ্বালানির আমদানি সংকটে পড়লে তার প্রভাব পুরো অর্থনীতিতেই পড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমার দেশকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বাংলাদেশকে দুই ধরনের হুমকিতে ফেলেছে। প্রথম হুমকি জ্বালানি নিয়ে অনিশ্চয়তা আর দ্বিতীয় হুমকি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি কমে যাবে। কারণ জ্বালানির মূল্য বাড়লে জাহাজ ও বিমান চলাচলের ব্যয় বাড়বে। এতে রপ্তানিপণ্যের দাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষÑদুভাবেই বাড়বে।