Image description

ইরান ও ইসরাইলের সংঘর্ষে নতুন করে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইরান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ, হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দিয়েছে। ইতিমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে। ফলে পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালি দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও জ্বালানি তেল সরবরাহে মারাত্মকভাবে ধাক্কা খাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশও এর তীব্র ক্ষতি থেকে রেহাই পাবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ কাতার থেকে কেবল হরমুজ প্রণালি দিয়েই এলএনজি আমদানি করতে হয়।

ইরানের প্রভাবশালী আইনপ্রণেতা ইসমাইল কোসারি ইরানি বার্তা সংস্থা আইআরআইএনএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি রপ্তানির পথ হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি বিবেচনা করছে ইরান। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে শুধু জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ এটি ইরানের হাতে থাকা অদৃশ্য বোমার মতো। ইরান সত্যিই প্রণালিটি বন্ধ করলে বিশ্ব জুড়ে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হতে পারে। যদিও বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানের পক্ষে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা সম্ভব নয়। কেননা, এটি ইরানের অর্থনীতির লাইফলাইন।

ব্যবসায়ীরা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং করোনার ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিশ্বে সরবরাহ ঘাটতির কারণে তেলের দাম বাড়তে পারে। ইতিমধ্যেই কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এ জি এম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, এ যুদ্ধের প্রভাবে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা পড়তে পারে।

বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি কী?: 
বাংলাদেশের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির প্রধান উৎস কাতার ও ওমান। এই দুই দেশ থেকে আসা সিংহভাগ এলএনজিই হরমুজ প্রণালি হয়ে বাংলাদেশে আসে। ফলে এই কৌশলগত নৌপথ বন্ধ হলে বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। 

মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের ৩০-৪০ শতাংশ তেল পরিবহন হয়। এ রুটটা বন্ধ করে দিয়েছে বা দেবে, এতে সারা বিশ্বে তেলের সংকট পড়বে।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, কাতারের সঙ্গে ১৫ বছর এবং ওমানের সঙ্গে ১০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে। চলতি অর্থবছরে কাতার থেকে ৪০টি এলএনজি কার্গো আসার কথা, যার মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত ৩৪টি কার্গো ইতিমধ্যেই দেশে পৌঁছেছে। তবে হরমুজ প্রণালির সম্ভাব্য সংকট ভবিষ্যতের সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।

জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এখনো পর্যন্ত সরবরাহে কোনো সমস্যা হয়নি। কাতারের সরবরাহকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক উভয়ের জন্যই সমস্যা সমান। তবে পরিস্থিতি যদি খারাপের দিকে যায়, তখন বিকল্প চিন্তা করতে হতে পারে।

বৈশ্বিক তেলের বাজারে অস্থিরতা: ইরান ও ইসরাইলের পাল্টাপাল্টি হামলার প্রভাব ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে দৃশ্যমান। মাত্র একদিনের ব্যবধানে অপরিশোধিত তেলের দাম ১২ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৭৮.৫ ডলারে পৌঁছেছে। জ্বালানি বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন যে, চলমান উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলে তেলের দাম ১০০ থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে।

দেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী প্রভাব: বাংলাদেশে গ্যাসের একটি বড় অংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প এলএনজিনির্ভর হয়ে পড়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি ও অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় এবং শিল্প খাতের উৎপাদন ব্যয়ও অনেকগুণ বেড়ে যাবে। এতে একদিকে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়বে, অন্যদিকে বিদেশি ক্রেতারাও তুলনামূলক বেশি দামের কারণে অর্ডার কমিয়ে দিতে পারেন, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে রপ্তানি আয়ের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

কেন এত গুরুত্বপূর্ণ: যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের মোট জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ এ পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। সংস্থাটি একে ‘বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথ’ বলে বর্ণনা করেছে। প্রণালিটির সবচেয়ে সরু অংশ ৩৩ কিলোমিটার (২১ মাইল) চওড়া। 
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী- কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর জ্বালানি রপ্তানির প্রধান পথ হলো হরমুজ প্রণালি। শুধু এলএনজি নয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) এক প্রতিবেদন অনুসারে, এ পথ দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যের যা প্রায় ২১ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, যেমন ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং বাংলাদেশ- এই গুরুত্বপূর্ণ রুটের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে এই দেশগুলোর জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সামগ্রিক অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে।

রেমিট্যান্স হ্রাস পেতে পারে: 
মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত প্রায় ৫০ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারেন। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহেও ভাটা পড়তে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এ জি এম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের একটা শ্রমবাজার আছে। সেখানে যদি সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের শ্রমবাজারে একটা প্রভাব পড়তে পারে। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।

শিল্প খাতের উদ্বেগ: দেশের শিল্প খাতেই এলএনজির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তাই এ জ্বালানির আমদানি সংকটে পড়লে তার প্রভাব পুরো অর্থনীতিতেই পড়বে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। 

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান এই সম্ভাব্য সংকটের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে কাতার থেকে এলএনজি আমদানি হুমকিতে পড়বে। ওই রুট বিপজ্জনক হলে স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ পরিচালকরা যাবেন না। আর গেলেও বীমা খরচ এত বেশি হবে যে, এলএনজি’র দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, এলএনজি’র দাম বেড়ে যেতে পারে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব সব খাতেই পড়ার কথা। আকাশপথে পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে লিড টাইম বেশি লাগবে।

হরমুজ প্রণালির অবস্থান: হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগরে যাওয়ার একমাত্র সামুদ্রিক প্রবেশপথ। এর এক পাশে ইরান, অন্য পাশে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে, প্রণালিটি পারস্য উপসাগরকে সরাসরি ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে এবং সেই পথ ধরে জাহাজগুলো আরব সাগরে তথা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে।

হরমুজ বন্ধ করা কি ইরানের পক্ষে সম্ভব: ইরানের আইনপ্রণেতা কোসারির ওই হুমকির পরও হরমুজ বন্ধ করার সক্ষমতা বা রাজনৈতিক ইচ্ছা আদৌ ইরানের আছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, একদম দেয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে এই প্রণালি বন্ধ করবে না ইরান। কেননা, এই প্রণালি দেশটির অর্থনীতির লাইফলাইন। ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক সংঘাতের সময় উভয় দেশই পারস্য উপসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছে। এই পর্বটি ‘ট্যাংকার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। তবে কখনোই হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি বন্ধ করেনি ইরান। এটি বন্ধ করলে ইরান নিজেই বিপদে পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।