
পতিত সরকারের আমলে গোপন করা খেলাপি ঋণের ভয়াবহ চিত্র বের হয়ে আসছে। প্রকৃত চিত্র বের করতে অনড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হচ্ছে না। আর এ কারণেই খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হওয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত বছরের মার্চে এ ঋণ দেখানো হয়েছিল এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই লাখ ৩৮ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ১৩১ ভাগ। আগামী জুন শেষে খেলাপি ঋণের এ চিত্র আরো ভয়াবহ রূপ নেবে বলে আভাস পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে জুন শেষে পৌনে ছয় লাখ কোটি থেকে ছয় লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকদের মতে, খেলাপি ঋণ যে অবস্থায়ই যাক না কেন, প্রকৃত চিত্র বের হওয়ার বিষয়ে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। আমরা চাই পতিত সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাতে যে পরিমাণ লুটপাট হয়েছে, তার প্রকৃতচিত্র বের হয়ে আসুক। স্বৈরাচারের লুটপাটের দায় বর্তমান সরকার নেবে না। আর এ কারণেই প্রকৃত অবস্থান বের করার পক্ষে তারা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। এস আলম, বেক্সিমকোর মতো একশ্রেণীর লুটেরা শ্রেণী দেশের ব্যাংক খাত থেকে পানির মতো অর্থ বের করে বিদেশে পাচার করেছে। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচারের বিদায়ের পর দেশের ব্যাংকিং খাতে যে পরিমাণ ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তার চিত্র বের হয়ে আসছে। স্বৈরাচারের সাথে ব্যাংক লুটেরাও পালিয়ে গেছে। এখন ওই সব ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। এতেই খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা; অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন গভর্নরের নেতৃত্বে জুন প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। তাড়াহুড়ো করে ওই সময় খেলাপির তথ্য প্রকাশ করায় প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যায়নি। এরপর নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকগুলোকে খেলাপির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার নির্দেশ দেন। এতে সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা; অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ৭৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। পরের প্রান্তিকে সরকারের কড়াকড়ির কারণে খেলাপি আরো বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। আর গত মার্চ পর্যন্ত এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ তিন লাখ ১৯ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৬ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১৩ লাখ ১০ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৪৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলো মার্চ পর্যন্ত ৬৭ হাজার ১৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি পরিমাণ তিন হাজার ২৩৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ।