দেশের অন্যতম ইসলামি রাজনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ আব্দুল কাদের লেখক হিসেবেও বেশ পরিচিত। আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনে দেশ ও ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন খেলাফত মজলিসের এই মহাসচিব। তবে তার এই প্রতিবাদী কণ্ঠ থামাতে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের পথ বেছে নেয় সরকার। বিনা অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করে সহিংসতার বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে সাড়ে ৪ মাস জেলবন্দি করা হয়। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক নির্যাতন করা হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের এই নায়েবে আমিরকে। আর জেল জীবনে নানা ভোগান্তিতে তার কিডনি প্রায় ড্যামেজ হয়ে যায়।
২০২১ সালে দেশে নরেন্দ্র মোদির আগমনবিরোধী প্রতিবাদ-বিক্ষোভের জেরে গণহারে গ্রেপ্তার-নির্যাতনের শিকার হন দেশের প্রতিবাদী আলেম-ওলামারা। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই গ্রেপ্তার আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করতেন অধ্যাপক আহমদ আব্দুল কাদের। তাতে শেষ পর্যন্ত সেই গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা পাননি তিনি।গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হওয়া প্রসঙ্গে তিনি আমার দেশকে বলেন, দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে আওয়ামী সরকার হেফাজতে ইসলাম নেতাদের তালিকা ধরে ধরে গ্রেপ্তার করা শুরু করে। ২০২১ সালে এ ধরনের ধরপাকড়ের কারণে যেকোনো সময় গ্রেপ্তারের বিষয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। একপর্যায়ে একটি সূত্রে গ্রেপ্তারের তালিকায় আমার নাম থাকার কথা জানতে পেরে নিজের বাসা ছেড়ে মেয়ের বাসায় অবস্থান নিয়েছিলাম। ২১ রমজান ইফতারের আগে আমার পশ্চিম আগারগাঁওয়ের বাসায় হানা দেয় গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু সেখানে আমাকে না পেয়ে ছেলেকে ধরে চাপ দিয়ে আমার অবস্থান নিশ্চিত করে পুলিশ। মেয়ের বাসা থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় আমাকে।
রমজানের রোজা শেষে যখন ইফতার সামনে নিয়ে বসে ছিলেন, তখনই প্রায় ৭০ বছর বয়সী এই ইসলামি চিন্তাবিদকে ধরতে আসে সাদা পোশাকধারী পুলিশ। এতে বাসার সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে সামান্য ইফতারের সুযোগ দেওয়ার পর তাকে ধরে নিয়ে যায় সোজা মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় একটি গারদ রুমে। ওই রুমে আগে থেকেই হেফাজতে ইসলামের বেশ কয়েকজন নেতা ছিলেন। এরপর শুরু হয় দুর্বিষহ জীবনযাপন।
আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, ডিবি হাজতে ছোট একটা রুমে তাদের ১২ জনকে রাখা হয়। একদিকে রোজার দিন, অন্যদিকে প্রচণ্ড গরম মৌসুম। রুমের বাইরে একটি ফ্যান থাকলেও তাতে কোনো কাজ হতো না। দুর্বিষহ জীবন কেটেছে সেখানে। স্বাভাবিকভাবে শোয়া বা ঘুমানোর সুযোগ ছিল না সেখানে। শোয়ার সময় একজনের মাথার দিকে আরেকজনের পা দিয়ে আমরা ঘুমাতাম। একটা বাথরুম থাকলেও তার কোনো দরজা ছিল না। সেটি ব্যবহারের সময় একটি শেড দিয়ে রাখা হতো, এতে বোঝা যেত যে ভেতরে কেউ আছে। রোজার সময় সেই রুমেই তারাবির নামাজ আদায় আর সাহরি খান তারা।
হেফাজতে ইসলামের এই শীর্ষ নেতা বলেন, গ্রেপ্তারের পর ডিবিতে এনে তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালের সহিংসতার একটি মামলা দেওয়া হয়। সেই মামলায় পরের দিন আদালতে তুলে পাঁচ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আদালতে তোলার সময় কয়েকজন পুলিশ তাকে হ্যান্ডকাফ পরায়। এভাবে যতবারই আদালতে তুলেছে, ততবারই তাকে হ্যান্ডকাফ পরায় পুলিশ।ডিবির রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসা করা হতো যে, আপনাদের আন্দোলনের অর্থের উৎস কী? ইউনিয়ন পর্যন্ত হেফাজতের কমিটি করছেন, এত টাকা কোথায় পাচ্ছেন? আমি বলেছিলাম, হেফাজতে ইসলাম করার জন্য অর্থের কোনো প্রয়োজন হয় না। যেকোনো জায়গায় গেলে এমনিতেই লোক আসে। হেফাজতের প্রোগ্রাম করতে একটা মাইক আর ব্যানার লাগে। লোকজনকে বললেই চলে আসে। তাদের পেছনে কোনো খরচ করতে হয় না। সবাই নিজের খরচেই এই আন্দোলন করেন।
রিমান্ড শেষে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয় খেলাফত মজলিসের এই নেতাকে। প্রথমে নেওয়া হয় কেরানীগঞ্জ কারাগারে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা লকআপে আটকে রাখা হতো। সাধারণ অন্য বন্দিদের মতো বাইরে বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো না। সেখান থেকে রোজার ঈদের আগে পাঠানো হয় কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। সেই কারাগারেই পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই ঈদ কেটে যায়।
তিনি বলেন, কাশিমপুর কারাগারের মান কিছুটা ভালো হলেও সেখানেও রাখার পর প্রথম দিকে আমাদের রুম থেকে বের হতে দেওয়া হতো না। অনেক দেনদরবার করে আধা ঘণ্টার জন্য বের হওয়ার সুযোগ দিত। সেই সুযোগে আমরা জোহর ও আসরের নামাজ পড়তাম। মাগরিবের নামাজের আগেই লকআপে ঢুকিয়ে তালা দেওয়া হতো। রাতে লাইট জ্বালানো থাকায় আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। এতে আমার কিডনি ড্যামেজ হয়ে যায়। আগে থেকেই আমার কিডনি সমস্যা ছিল। সেই সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় জেলের ডাক্তার কিছু চিকিৎসা দেন। আমরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানালেও জেল কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি।
এভাবে সাড়ে ৪ মাসের মতো জেলে কাটিয়েছেন তিনি। আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, পতিত আওয়ামী সরকারের সময় আমার ওপর ব্যাপক জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় মাত্র একটি মামলা দেওয়া হয়। পরে জেলখানায় থাকাবস্থায় একের পর এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কিছু মামলা ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার, অনেকগুলো ছিল ২১ সালের মোদিবিরোধী আন্দোলনের সময়কার। হাটহাজারীতে ছাত্র মারা যাওয়ার ঘটনায়ও আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে।কারাবন্দিত্বের সময় পরিবারের ওপর প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার ছেলেমেয়েরা সবাই বড় হয়ে গেছে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। আমার গ্রেপ্তার নিয়ে তারা সবাই উদ্বিগ্ন ছিল। তবে সবাই ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।
আওয়ামী আমলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নানা ধরনের বাধা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, তারপরও আমরা বাধা উপেক্ষা করে যতটুকু পেরেছি করেছি। তিনি বলেন, পুলিশের গ্রেপ্তারের তালিকায় নিজের নাম থাকার খবর আগেই পেয়েছিলাম। সে সময় অনলাইন মিটিংয়ে তিনি নেতাকর্মীদের বলেন, গ্রেপ্তার কপালে থাকলে হতেই হবে, এটা ঠেকানো যাবে না। আমাদের আগের বড় বড় আলেম-ওলামা, ইমাম সাহেবরাও জেলখানায় গেছেন। জেলখানা হলো আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের পূর্বপুরুষ আলেমরাও গ্রেপ্তার হয়েছেন। কাজেই এটা নিয়ে ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। জেল-জুলম আসবেই, এটাকে বরণ করতে হবে, ধৈর্যধারণ করতে হবে।
কারামুক্তির পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না তার। তিনি দলীয় কার্যালয়ে গেলে সেখানে গোয়েন্দারা বসে থাকতেন। তবে ওই পরিস্থিতিতেই কারামুক্তির সপ্তাহখানেক পর স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। জুলাই বিপ্লবের পর এখন সাধারণ নাগরিকদের মতো আলেম-ওলামারাও খুব স্বস্তিতে আছেন বলে জানান ড. আহমদ আব্দুল কাদের।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালে আলেম-ওলামাদের ওপর সবচেয়ে বড় জুলুম-নির্যাতন হয়েছিল। শাপলা চত্বরে ওই জুলুমটা হয়েছিল একদম নিরীহ লোকদের ওপর। সেখানে অল্পবয়সীরাও ছিল। মানুষ মারার কথা সরকার স্বীকার করেনি, কিন্তু বেসরকারি বিভিন্ন হিসাবে দেখা গেছে, কমপক্ষে ২০০ লোক মারা গেছে।শাপলা চত্বরের ওই ঘটনার পর সারাদেশে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কমিটির তালিকা দেখে দেখে আলেমদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এই মামলাগুলো চালু ছিল না, ২০২০-২১ সালে যখন হেফাজত পুনর্গঠন হলো, তখন সেই মামলাগুলো নতুন করে চাঙা করা হয়। সে সময় দেশের শীর্ষ আলেম-ওলামাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে হাটহাজারীতে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনেক ছাত্র ও মানুষ মারা গেছে। এরপর শত শত মানুষের নামে নতুন করে মামলা হয়।
স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার মিথ্যাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াতকারী বলে প্রচার করা হতো। আল্লাহই ভালো জানেন। তবে বাস্তব কর্মকাণ্ড ছিল তার উল্টো। আলেম-ওলামাদের ওপর নির্যাতন, গ্রেপ্তার, মামলা দিয়ে হয়রানি করা, হাজার হাজার মানুষকে জেলে ঢোকানোÑ এসব কাজ করার পরও যদি কেউ বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি, বিষয়টি তো কষ্টকর। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞ তো চোখের সামনে ঘটেছে। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতায় থাকার জন্য দুই হাজার মানুষ মেরে ফেলতে পারে, ২০-৩০ হাজার মানুষকে পঙ্গু করতে পারে এটা তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।