Image description
স্বেচ্ছায় অর্থ ফিরিয়ে দিলে কঠোর দণ্ড মওকুফ হতে পারে

বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশি সম্পদ জব্দ ও ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো এতটা সুসংগঠিত ও বহুমাত্রিকভাবে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের খোঁজ, জব্দ এবং পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শুধু যুক্তরাজ্যেই এখন পর্যন্ত ৪২০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ জব্দ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। অন্যদিকে, মালয়েশিয়া, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরে ছড়িয়ে থাকা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের নামে থাকা সম্পদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গত তিন মাসে ৪৬ জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিশদ প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। এর ভিত্তিতে অন্তত ১১টি দেশে ৩৭টি আইনি অনুরোধ (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট বা এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ পাচার রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য হলেও এটি অত্যন্ত ধীর ও জটিল একটি প্রক্রিয়া। সেই বাধা অতিক্রম করতেই এবার সরকার ‘ভিন্ন কৌশল’ নেওয়ার পথে হাঁটছে। এরই মধ্যে যেসব ধনকুবের বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন তাদের সঙ্গে আর্থিক সমঝোতায় পৌঁছানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এ ছাড়া স্বেচ্ছায় অর্থ ফেরতের সুযোগ, কর রেয়াতের বিনিময়ে পুনর্বিনিয়োগ, দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় সম্পদ হস্তান্তর এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কূটনীতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) যৌথভাবে পাচার হওয়া অর্থের উৎস, প্রক্রিয়া এবং গন্তব্য চিহ্নিত করতে গোপন অনুসন্ধান চালিয়েছে। এই অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশের মোট পাচার হওয়া অর্থের অন্তত ৬২ শতাংশ গেছে তিনটি দেশে—যুক্তরাজ্য, কানাডা ও মালয়েশিয়ায়। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রেও বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে রিয়েল এস্টেট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, শেল কোম্পানি ও ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে।

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ও সেরিয়াস ফ্রড অফিস (এসএফও) এরই মধ্যে তিনজন ব্যবসায়ীর ৯টি অ্যাপার্টমেন্ট, দুটি অফিস স্পেস এবং চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে। ওই তিন ব্যবসায়ীর প্রত্যেকেরই বাংলাদেশে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। তারা হচ্ছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান ও ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমান। তাদের মধ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর একাধিক সম্পত্তি ফ্রিজ এবং সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার প্রায় ৯ কোটি পাউন্ড মূল্যের লন্ডনের ৯টি সম্পত্তিও জব্দের আওতায় এসেছে। এনসিএ জানিয়েছে, এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেওয়া তথ্যমাফিক এবং দেওয়ানি তদন্তের অংশ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। জব্দ হওয়া সম্পদগুলো বর্তমানে বিক্রি বা হস্তান্তর করা যাবে না।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে উদারনীতিক। ফলে বিদেশি বিনিয়োগের আড়ালে সহজেই অর্থ পাচার হয়েছে। তবে এখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় আমরা সেই সম্পদগুলো চিহ্নিত করে জব্দ করতে পারছি।

ড. ইউনূসের তৎপরতা: পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরে রয়েছেন। তিনি এরই মধ্যে লন্ডনে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা, ট্রেজারি এবং ফ্রড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, বরং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে পাচারকৃত সম্পদ ফিরিয়ে আনতে চায়।’

তার নেতৃত্বে ‘অর্থ পুনরুদ্ধার টাস্কফোর্স’ এখন দেশের বাইরে থাকা নথিভিত্তিক প্রমাণ উপস্থাপন করছে। এতে যুক্তরাজ্যের মতো দেশে আদালতের মাধ্যমে জব্দ আদেশ পাওয়া সহজ হচ্ছে। ড. ইউনূস আরও জানান, অর্থ ফেরতের ক্ষেত্রে কিছু ‘স্ট্র্যাটেজিক চুক্তি’ও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে, যার আওতায় অপরাধীরা স্বেচ্ছায় অর্থ ফিরিয়ে দিলে কঠোর দণ্ড মওকুফ হতে পারে।

পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ভিন্ন কৌশল: অর্থ ফেরানোর প্রচলিত পদ্ধতিগুলো অনেক সময় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে। ফলে এবার সরকার বিকল্প ও কার্যকর কিছু কৌশল নিচ্ছে। একটি সূত্র জানায়, অন্তত ১২ জন ব্যবসায়ী মালয়েশিয়া ও কানাডা থেকে স্বেচ্ছায় অর্থ ফেরত দিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিনিময়ে তারা চান যেন কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের মামলায় কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি ‘স্বচ্ছতা স্কিম’ চালুর চিন্তা করছে, যার আওতায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিদেশি সম্পদ ঘোষণার সুযোগ থাকবে। এ ক্ষেত্রে কর দিতে হলেও দণ্ড মওকুফ করা হতে পারে। এর আদলে ২০১৮ সালে ভারতের ‘ব্ল্যাক মানি অ্যাক্ট’ এবং মালয়েশিয়ার ‘স্বেচ্ছা ফেরত কর্মসূচি’কে অনুসরণ করা হয়েছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কথিত কার্যকলাপের প্রকৃতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ নির্ভর করবে। যদি আইন লঙ্ঘনের প্রকৃতি তুলনামূলকভাবে হালকা ধরনের হয়...তবে আমরা দেওয়ানি মামলা করব এবং সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আর্থিক সমঝোতার কথা বিবেচনা করা হবে। তবে সম্ভাব্য কোন ব্যক্তিরা এ প্রক্রিয়ার আওতায় আসতে পারেন, সে বিষয়ে কোনো উদাহরণ দেননি তিনি।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনার বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির (এনসিএ) সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পাচারের অর্থ শনাক্ত, কীভাবে পাচার হয়েছে, তা খুঁজে বের করা ও জব্দ করার বিষয়ে এনসিএর ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ বিষয়ে সংস্থাটি এরই মধ্যে দুটি পদক্ষেপও নিয়েছে।

অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও চ্যালেঞ্জ: জাতিসংঘ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ফিনসেন্ট ও গ্লোবাল ফোরাম অন ট্রান্সপারেন্সির মতো সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এরই মধ্যে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে এবং সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তবে এই প্রচেষ্টার সামনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো—রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বিদেশি রাষ্ট্রের অনীহা, বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং সম্পদের মালিকানার গোপন কাঠামো (যেমন অফশোর কোম্পানি বা বেনামি ট্রাস্ট)। পাশাপাশি, দেশের অভ্যন্তরে কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপও এই উদ্যোগকে দুর্বল করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের সম্মিলিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থ পাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ব্যাংক হাওলা, আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং, বেনামি বিনিয়োগ ও দ্বিতীয় নাগরিকত্ব। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে পাঁচটি বড় শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গত দুই বছরে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মামলা হয়েছে এবং তিনজনের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।

যেভাবে ফিরবে পাচারের অর্থ: অ্যাসেট রিকভারি বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বিদেশি সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এক বছরের একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চার ধাপে কাজ করবে টাস্কফোর্স। প্রথম ধাপ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে কাজ চলছে।

জানতে চাইলে এ-সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, আমাদের প্রথম এজেন্ডা ছিল এসেট ট্রেসিং বা বিদেশি সম্পদ নির্ণয় করা। আমরা এটা এরই মধ্যে সফল করতে পেরেছি। দ্বিতীয় ভাগের কাজ হচ্ছে, দেশে এবং বিদেশি আমরা কীভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় এগোব, সেই বিষয়টি। এ বিষয়ের অধীনে অ্যাসেট রিকভারি আইনে সংশোধন আনা হচ্ছে। দ্রুতই বিষয়টির কাজ শেষ হবে। আইনটি হয়ে গেলে আমরা দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব। এ ছাড়া দেশে ও বিদেশে আইনজীবী এবং এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হবে। এ বিষয়গুলোর কাজ এখন চলমান।

তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় ধাপের কাজ শেষে আমাদের নিয়োগ করা আইনজীবী ও এজেন্টরা দেশে বিদেশে আইনি লড়াই করবেন। আর চতুর্থ ধাপে আমাদের বিদেশ থেকে টাকা আসতে শুরু করবে। অর্থাৎ আগামী ডিসেম্বর থেকে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আশা শুরু করবে।

বিএফআইইউর একটি সূত্র বলছে, বিদেশি সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী যৌথ তদন্ত দল (জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম) গঠন করেছে। তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি ফ্লোর বরাদ্দ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক রিকিউজেশন অনুযায়ী ক্লাস্টার টাইপ সিকিউরিটি সিস্টেম ও রুম করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সব কিছুই করা হয়েছে আন্তর্জাতিক নিময় অনুযায়ী। ইতোমধ্যে জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিমের (জেটিআই) সদস্যরা নিয়মিত অফিস শুরু করেছেন।

জানতে চাইলে বিএফআইইউর এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি সম্পদ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশে আইনজীবী ও এজেন্ট নিয়োগের কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। অর্ডিন্যান্স হয়ে গেলেই তৃতীয় ধাপে আমাদের আইনি লড়াই শুরু হয়ে যাবে। এজন্য বিদেশি সংস্থাগুলোর সঙ্গে আমরা নিয়মিত বৈঠক করছি। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউনাইটেড স্টেট অব ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস, ইইউকে, কানাডিয়ান অ্যাম্বাসিসহ বেশকিছু দেশ ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। শুধু অ্যাসেট রিকভারি ও টাস্কফোর্স সংক্রান্ত একেকদিন আমাদের ৮-১০টি করে মিটিং হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, অর্থ উপদেষ্টার কার্যালয়, জাতীয় বিভিন্ন কমিটি ও আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্স কমিটির বিভিন্ন মিটিং হচ্ছে।