Image description

‘ঝড়ো বাতাসে মনে হয় যেন ঘর কাঁপছে। বৃষ্টি এলে ঘরে ঢোকা দায়। দেয়ালগুলো ফেটে এপার-ওপার দেখা যায়। আগে যে গাছতলায় ছিলাম তাতেই আমরা অনেক শান্তিতে ছিলাম মনে হয়। বড় ধরনের ঝড় হলে ঘর মাথার ওপরে ভেঙে পড়ার ভয়ে থাকি। সরকারের কেউ আসে না আমাদের খোঁজ-খবর নিতে। সরকার অনেক টাকা খরচ করে ঘর দিয়েছে। অথচ এই এলাকায় কোনো রোজগার করার উপায় নেই। এমনকি সরকারি কোনো রিলিফ, ভাতা বা আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয় না। এই কারণে এখানে থাকার পরিবেশ নেই।’

আক্ষেপ করে কথাগুলো ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নের বরুনাগাঁও এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মরিয়ম বেগম। তিনি সেখানে পরিবার নিয়ে থাকেন। এমন দুরবস্থা ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রত্যেকটি ঘরের। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঘরগুলোর পলেস্তারা খসে পড়া, সুপেয় পানির সংকট, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই পানি চলে আসা, রাস্তা ও শৌচাগারগুলোর দুরবস্থা। টাকার বিনিময়ে ঘর হস্তান্তরের অভিযোগ উঠেছে জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে উপজেলার আকচা ইউনিয়নের চিলারং, রহিমানপুর, মোহাম্মদপুর, সালন্দর, সেনুয়া, গড়েয়া, বালিয়াসহ ২২টি ইউনিয়নে মোট ২ হাজার ২৪০টি ঘর নির্মাণ করে উপকারভোগী পরিবারকে ২ শতক জমিসহ ঘরগুলো বাসিন্দাদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় প্রতিটি ঘর তৈরিতে ব্যয় ধরা হয় ২ লাখ টাকা।

প্রকৃত ভূমিহীন বাছাই করতে না পারা, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক অনিয়ম করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়া প্রকল্পের অধিকাংশ ঘর এক নামে বরাদ্দ নিলেও থাকছেন অন্যরা। তাদের অভিযোগ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ও কাজের অভাবে অনেকেই আশ্রয়ণের ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

জানা গেছে, আশ্রয়ণের অধিকাংশ ঘরই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। যারা থাকছেন, তাদের বেশিরভাগেরই নিজের নামে ঘর বরাদ্দ নেই। যাদের নামে বরাদ্দ ছিল তারা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখে পালিয়ে গেছে। তাদের রেখে যাওয়া ঘরগুলোতে অন্য বাসিন্দারা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে বসবাস শুরু করলে এখন তারা এসে তাড়িয়ে দিচ্ছেন।

এদিকে ঘর ছেড়ে সুবিধাভোগীরা চলে যাওয়ায় বিল বকেয়া পড়ছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির। মানুষ না থাকলেও মিটার থাকায় মাসে মাসে বিল ধার্য হচ্ছে প্রতিটি হিসাব নম্বরের বিপরীতে। বিলের কপি পড়ে থাকছে ঘরগুলোর দরজার ফাঁকে।

সম্প্রতি, আকচা, বরুনাগাঁওসহ বিভিন্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ৩ বছর আগে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ৩ বছর যেতে না যেতেই ঘরগুলোর এখন বেহাল অবস্থা। বেশিরভাগ ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরে পলেস্তারা খসে পড়ছে। ফলে যে কোনো মুহূর্তে দেয়াল ভেঙে পড়ার শঙ্কায় দিন কাটছে বাসিন্দাদের। এখানে বসবাসরত পরিবারের সবারই একই অবস্থা।

তাদের অভিযোগ, নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার ও মানসম্মতভাবে ঘরগুলো নির্মাণ না করায় ৩ বছরের মধ্যেই অধিকাংশ ঘরগুলোর ভেতরে ও বাইরে ফাটল দেখা দিয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ফেটে যাওয়া এসব ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে বসবাস করছেন ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষ। ঘর নির্মাণের সময় নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার ও মানসম্মতভাবে ঘরগুলো নির্মাণ না করার কারণে অধিকাংশ ঘরের ভেতরে ও বাইরে ফাটল দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতে ঘরগুলোতে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বরুনাগাঁও, আকচা ও সালন্দর আশ্রয়ণের ঘরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাসিন্দাদের কেউ ভালো নেই। সবার ঘরে কিছু না কিছু সমস্যা আছেই। তাদের ভাষ্য ঘর পাকা হলেও ভয় নিয়ে বসবাস করতে হয়। অল্প টাকায় বারান্দাসহ তিন কক্ষের ঘর বানানো হয়েছে। কাজ হয়েছে একেবারে নিম্ন মানের। দেওয়া হয়নি পরিমাণ মতো সিমেন্ট, পিলারে নেই রড। ঘর হস্তান্তরের সময় রং করে চাকচিক্য দেখানো হয়েছিল। ৩ বছর না হতেই এখন ঘরের দেয়াল ভেঙে যাচ্ছে। আর দুই বছর টিকবে কি না সন্দেহ।

আনোয়ার হোসেন বলেন, বড় আশা নিয়ে এখানে এসেছিলাম। অথচ এখানে গরু-ছাগলও চরানোর উপায় নেই। যাতায়াতের রাস্তা নেই, কোনো ব্যবসা করার সুযোগ নেই। এই ঘরে থাকতে হলে বহু দূরে গিয়ে কাজ করতে হবে, নয়তো না খেয়ে পড়ে থাকতে হবে এখানে। তিনি আরও বলেন, রাতে যে আরামে ঘুমাবেন, সেই উপায়ও নেই। জিনিসপত্র চোরে নিয়ে যায়।

কয়েকজন শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আশপাশে কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। প্রতিদিন ৫-৬ কিলোমিটার হেঁটে স্কুল-মাদরাসায় পড়তে যেতে হয়। অনেক কষ্ট হয় এত রাস্তা হাঁটতে। এই কারণে প্রায়ই স্কুলে যাওয়া হয় না।

আরেক বাসিন্দা আরিফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘরে বালুর জন্য থাকা যায় না। হাত দিলেও পলেস্তারা খুলে পড়ে যায়। শৌচাগার ঘরের মধ্যে বানানো হয়েছে। অথচ ওপরের অংশ খোলা। ঘরের মধ্যে সব সময় দুর্গন্ধ থাকে। দেড় ফুট উচ্চতার তিনটি চাকা দিয়ে সেপটিক ট্যাংক করা হয়েছে। প্রতি মাসেই শৌচাগার মলমূত্রে ভরে যায়। আশ্রয়ণের ২টি ঘরের জন্য একটি টিউবওয়েল ছিল, সেটাও চুরি হয়ে গেছে।

অপর বাসিন্দা সুখী আক্তার বলেন, আশ্রয়ণের প্রায় প্রতিটি ঘরের ভেতরে ও বাইরে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটলের কথা বললে, অফিসের লোকজন আজ না কাল বলে দিন কাটাচ্ছে। ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে আমাদের। ঝড়-বৃষ্টি হলে ভয়ে ঘরে থাকার উপায় থাকে না। সরকার যদি আবার ঘরগুলো মেরামত করে দিত তাহলে উপকার হতো।

সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খাইরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের কিছু ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে সেটা আমি নিজেও দেখে এসেছি। সরকার যদি কোনো বরাদ্দ দেয় তাহলে মেরামত করা হবে। আর যারা ঘর নিয়েও থাকে না তাদের ঘরগুলো চিহ্নিত করে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের লোকজনকে তুলে দেওয়া হবে। যারা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করেই চলে গেছে এবং যিনি অর্থ লেনদেন করছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।