
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর উচ্চহারে বিশ্বে শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। প্রতিদিন গড়ে ৪১ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। বছর শেষে এই প্রাণহানি ১৫ হাজারে গিয়ে পৌঁছায়। এভাবে নানা বয়সী মানুষের মৃত্যু ঘটলেও শিশুর সংখ্যা বেশি বলে উঠে এসেছে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) প্রতিবেদনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের সময় অনেকে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পুকুর বা জলাশয়ে সাঁতার কাটার চেষ্টা করে। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া অসতর্কতার কারণে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। একটু সচেতন হলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, কিছু সহজ পদক্ষেপ নিলে শিশুদের ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব। তা হলো ছোট শিশুদের নজরে রাখা, বিশেষ করে যখন তারা পানির আশপাশে থাকে।
প্রতিবার ঈদের সময় পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যায়। ঈদের পরের দুই দিনে (রবিবার ও সোমবার) অন্তত ৩০ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই শিশু।
ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান শিশুস্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ ও অপমৃত্যু রোধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘অপঘাতজনিত কারণে আমাদের দেশে প্রতিবছর যত শিশু মারা যাচ্ছে, তার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া। বিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সর্বাধিক। এর মধ্যে আবার সর্বাধিক ভারতে। কিন্তু জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে যত শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে, তা ভারতের চেয়ে বেশি। সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ সরকারের পরিকল্পনায় আছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধির প্রতিরোধ কার্যক্রমের আওতায় এজেন্ডা আছে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমানোর।’
সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে ‘জীবন রক্ষার উদ্যোগে ইউনিসেফের অঙ্গীকার’ শীর্ষক পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মশালায় ইউনিসেফ বাংলাদেশের অফিসার ইনচার্জ ও চাইল্ড প্রটেকশন চিফ ড. এলিসা কল্পনা বলেন, ‘বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ইউনিসেফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। সুইমসেফ প্রগ্রামের মাধ্যমে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জীবন রক্ষাকারী দক্ষতা শেখানো হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই প্রগ্রাম শুধু জীবন বাঁচায় না, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধেও সহায়তা করে। খেলাধুলার মাধ্যমে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তাদের ভবিষ্যত্ গড়ার পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা দেয়, যা সমাজের ক্ষতিকর প্রথাগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহায্য করে।’
বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন ও শিশু একাডেমির (আইসিবিসি প্রজেক্ট) প্রগ্রাম ম্যানেজার মো. তারিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘শিশুদের জন্য সাঁতার প্রশিক্ষণের সুযোগ সহজলভ্য করতে হবে, যাতে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কার্যক্রম শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।’
ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কয়েকটি ঘটনা : ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে গত সোমবার বিকেলে নদীতে ডুবে সিনান (২) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের চরগোরকপুর এলাকায় কংস নদীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সিনান ওই এলাকার মো. মোনায়েম হোসেনের ছেলে।
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে পানিতে ডুবে আয়াত (২) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত সোমবার উপজেলার আউটশাহী ইউনিয়নের মুসল্লিপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শিশুটি গ্রামের রাসেল ছৈয়ালের ছেলে।
চট্টগ্রামের পটিয়ায় পুকুরে ডুবে চাচা-ভাতিজার মৃত্যু হয়েছে। গত সোমবার দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় একটি পুকুরে ডুবে এ দুজন মারা যায়। তারা হলো উপজেলার আশিয়া ইউনিয়নের মধ্যম বাথুয়া ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বজল আহমদের ছেলে মোহাম্মদ নাছির (৫৫) ও তাঁর ভাতিজা মোহাম্মদ আইরিয়ান (১৫)। এ ছাড়া লোহাগাড়ায় ইটভাটার পুকুরে ডুবে মোহাম্মদ তানজিম (৪) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
কক্সবাজার সৈকতের কলাতলী সায়মন বিচ পয়েন্ট এলাকায় গত সোমবার দুপুর ২টার দিকে গোসলে নেমে শাহীনুর রহমান (৬০) এবং তাঁর ছেলে সিফাত (২০) মারা যান। তাঁরা রাজশাহী থেকে কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছিলেন।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের হামিদপুর গ্রামে মেয়েকে সাঁতার শেখাতে গিয়ে গত সোমবার দুপুরে পুকুরে ডুবে বাবা-মেয়ের মৃত্যু হয়। মৃত দুজন হলো হামিদপুর গ্রামের বাসিন্দা ইটভাটা ব্যবসায়ী বাবুল আহমদ (৬০) ও তাঁর মেয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী হালিমা মোহাম্মদ (১৭)।