Image description
চকরিয়ার জাফর আলম ‘ডাকাত থেকে এমপি’ । এক পরিবারেরই ১৩ কোটি টাকার জমি জবরদখল । জমি দখলে ছিল বিভিন্ন বাহিনী ।

জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে জমি দখল ছাড়াও বিভিন্ন অপকর্মে দাপুটে হয়ে উঠেছিলেন কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জাফর আলম। ক্ষমতার দাপট ও জালিয়াতির মাধ্যমে নিরীহ শত মানুষের বিপুল পরিমাণ টাকার জমি হাতিয়ে নিয়েছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে খোদ একটি পরিবারেরই প্রায় ১৩ কোটি টাকা মূল্যের জমি নিজ পরিবারের সদস্যসহ সাঙ্গপাঙ্গদের নামে অবৈধভাবে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। প্রতারণার মাধ্যমে জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়া ছাড়াও শত একরের চিংড়িঘের জবরদখলের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জাফর শুধু চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার সাধারণ লোকজনের জমি জবর দখল করে বসে থাকেননি, তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানাধীন চকরিয়ার রামপুরা মৌজার ৩০০ একরের আধুনিক পদ্ধতির চিংড়িঘেরও দখল করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্ষমতায় থাকাকালে ২০২১ সালের ৫ জুলাই রাতে সেই ঘেরটি দখলে নিয়েছিলেন। ওই রাতে জাফর বাহিনী প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকার চিংড়ি মাছ লুট করে। কেটে নিয়ে যায় ঘেরটির এক হাজার ৮০০টি নারকেলগাছ।

জাফর বাহিনীর জবরদখলের বিষয়টি এখনো ভোলেননি গ্রামীণ চিংড়ি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক উত্পল কান্তি চৌধুরী। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাফর আলমের সশস্ত্র লোকজন যখন ঘের দখল করেছিল, তখন আমাদের লোকজন পালিয়ে কোনো রকমে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। দখলবাজরা সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা প্রকল্পটির সব অবকাঠামো ভেঙে চুরমার করে ফেলেছিল। এ ব্যাপারে চকরিয়া থানায় সে সময় মামলা দিতে গেলে পুলিশ সাবেক এমপি জাফরের নাম বাদ দিয়ে অন্য কিছু লোকের নামে একটি মামলা রেকর্ড করেছিল। মামলাটি বর্তমানে চকরিয়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন।

তিনি জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গ্রামীণ কর্তৃপক্ষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তায় যথারীতি ঘেরে গিয়ে নতুন করে চিংড়ি চাষ শুরু করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় আন্ত জেলা ডাকাত হিসেবে কুখ্যাতি ছিল কক্সবাজারের চকরিয়ার জাফর আলমের। তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে আরো দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-১ আসনে ভোট ডাকাতি করে এমপি হয়েছিলেন।

 
তার আগে ২০১৪ সালে পাঁচ শতাধিক সন্ত্রাসীর প্রকাশ্য ভোট ডাকাতিতে চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। জানা গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে এমপি হওয়ার পর চার বছরেই শত কোটিপতি বনে যান। স্ত্রী-সন্তানদের নামে ২০০ জমির দলিলের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় জমি দখল ও সম্পদ লুটপাটে জাফর আলমের আলাদা বাহিনী ছিল। চকরিয়া উপজেলায় তাঁর ভাতিজা মো. জিয়াবুল হক, ভাগ্নে মো. মিজানুর রহমান, ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর, চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জামাল উদ্দীন, সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নবী হোসাইন চৌধুরী ওরফে নইব্যা চোরা ও বহদ্দারকাটার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ছিল আলাদা বাহিনী। পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম ও টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলামের নেতৃত্বেও ছিল আলাদা দুটি বাহিনী। এসব বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল চিংড়িঘের দখল করে টাকা আদায় করা, সরকারি পাহাড়ের বৃক্ষ নিধন ও মাটি কেটে বিক্রি করা, গোয়ালের গরু জোর করে নিয়ে যাওয়া। সাবেক চেয়ারম্যান নবী হোসাইন ওরফে নইব্যা চোরার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিশাল বাহিনীর কাজ ছিল বিভিন্ন এলাকা থেকে রাতের আঁধারে অস্ত্রের মুখে গরু-মহিষ নিয়ে আসা।  নবী হোসাইনের বিরুদ্ধে গরু চুরির অপরাধে কমপক্ষে এক ডজন মামলা রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, জাফর আলমের চেয়ে জমি জবরদখলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন তাঁর স্ত্রী শাহেদা বেগম। শাহেদা চকরিয়ার স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তবে স্বামীর এমপি পদের জোর দেখিয়ে স্কুলে না গিয়েই মাসের শেষে উপস্থিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে পরে বেতন-ভাতা নিতেন। শাহেদা চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলার অবৈধ বালু উত্তোলনের একাধিক চক্রের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। চকরিয়ার চিরিঙ্গা বাসস্টেশনের কাছে বিতর্কিত জমিতে গড়ে তোলা হয়েছিল শাহেদা কমপ্লেক্স নামের বিশাল বাণিজ্যিক ভবন। গত বছরের ৫ আগস্ট সংক্ষুব্ধ জনতা সেটি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে।

জাফর আলম চকরিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সনদধারী দলিল লেখক মাসুদুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত চক্রকে কাজে লাগিয়েছিলেন। তাঁরা জমি বাগিয়ে নিতে জাল-জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাসুদচক্র জীবিত ব্যক্তিকে মৃত ও স্বত্বহীন ব্যক্তিকে স্বত্ববান দেখিয়ে জোরজবরদস্তি করে জমি রেজিস্ট্রি করিয়ে নিত। চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার বহু নিরীহ মানুষ বৈধ সম্পদের দখল হারিয়ে এখন পথে পথে ঘুরছেন। জালিয়াতি ও প্রতারণার শিকার স্থানীয় দুজন ভুক্তভোগী ২০২২ সালে চকরিয়ার দলিল লেখক মাসুদুল ইসলামের সনদ বাতিলসহ শাস্তির দাবিতে বাংলাদেশ নিবন্ধন অধিদপ্তরে লিখিতভাবে আবেদন করেছিলেন। তবে এমপি জাফর আলম ক্ষমতার প্রভাব দিয়ে মাসুদুলকে রক্ষা করেছিলেন। ভুক্তভোগী চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কামরুল হাসান রওফে মোহাম্মদ হোসেন (শিক্ষক) জানান, তাঁর পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত নিজ নামে বিএস রেকর্ডভুক্ত চকরিয়ার ঢেমুশিয়া মৌজার বিএস ৫২৯ নম্বর খতিয়ানে ছয় একর ৯ শতক জমি লিপিবদ্ধ আছে। তাঁর বাবা ফজলুর রহমান ও মা নূরুন্নাহার ভূমির প্রকৃত মালিক। ওই জমি ভিন্ন লোকের জাতীয়তা সনদ ও ছবিসহ দাতা বানিয়ে ২০২০ সালের ৯ আগস্ট ২৩৫০ নম্বর জাল দলিল সৃজনের মাধ্যমে জাফরের স্ত্রী শাহেদা বেগম ও পেকুয়া উপজেলা কৃষক লীগের সাবেক আহ্বায়ক মেহের আলীর নামে রেজিস্ট্রি করিয়ে নেওয়া হয়। প্রতারণামূলক জাল দলিল সৃজন করেন দলিল লেখক মাসুদুল ইসলাম। জমির প্রকৃত মালিক একজন শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও বিক্রি দলিল সম্পাদিত হয় টিপ সহির মাধ্যমে।

আরেক ভুক্তভোগী চকরিয়া উপজেলার পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের ইলিশিয়া জমিদার বাড়ির বংশধর মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী নায়েলা মোস্তাক বলেন, তাঁর মা ছলিমা খাতুন পশ্চিম বড়ভেওলা মৌজার  বিএস ২২১ নম্বর খতিয়ানে ২৬.৩ একর ভূমি থেকে ১৫ আনা অংশে ২৪.৪০৩১ একর ভূমির মালিক হন। ছলিমা মারা যাওয়ার সময় নায়েলাসহ  ৯ ভাই-বোন রেখে যান। তিনি জীবদ্দশায় ২০১৬ সালের ৭ আগস্ট নায়েলা মোস্তাকসহ চার বোনকে ৩৩২৬ নম্বর হেবা দলিল মূলে ১৯.৫৬ একর ভূমি হস্তান্তর করেন। অথচ সেই ছলিমা খাতুন অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যু দেখিয়ে সমুদয় ভূমি তাঁর একমাত্র ভাই আবদুর রহমানের প্রাপ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত দলিলে। নায়েলা জানান, আবদুর রহমান নামে তাঁর কোনো ভাইও নেই। তিনি জানান, প্রতারণামূলক সব দলিল সৃজন করেন দলিল লেখক মাসুদুল ইসলাম। এভাবে বানোয়াট ও জাল ওয়ারিশ সনদে সাতটি দলিল মূলে মোট ২২.৬৯৫৭ একর বা ৬৮ বিঘা ভূমি জাফর আলমের মেয়ে তানিয়া আফরিনসহ পরিবারের আরো সদস্য এবং ঘনিষ্ঠদের নামে দলিল তৈরি করেন দলিল লেখক মাসুদুল ইসলাম। এসব জাল দলিল যথাক্রমে ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট  দলিল নম্বর ৩৬৩৪, ৩৬৩৫, ৩৬৩৬, ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ৪২৬৩, ৪২৭৭, একই সালের ৩১ আগস্ট ৪০১১ এবং ৩ অক্টোবর তারিখে ৪৪৪৯ নম্বর দলিল সম্পাদিত হয়। এভাবে কেবল একটি পরিবারেরই প্রায় ১৩ কোটি টাকার জমি দখল করে নেন জাফর। অথচ জমির প্রকৃত মালিক দাবিদার ব্যক্তিরা ঘুরছেন পথে পথে।

চকরিয়ার সাব-রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েক মাস আগে এখানে যোগদান করেছি। তবে শুনেছি সেই সময় (সাবেক এমপি জাফরের সময়) অনেক ঘটনা ঘটেছে, যার অনেক কিছুই বলা যাচ্ছে না। এসব অনিয়ম নিয়ে অফিসে অভ্যন্তরীণ তদন্তও চলছে। দলিল লেখক মাসুদুল ইসলাম জাফর আলমের পক্ষে জমি রেজিস্ট্রি করিয়ে দিতে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি রেকর্ডপত্র যেভাবে পেয়েছি সেভাবে দলিল লিখে দিয়েছি। এখানে কোনো দোষ হলে তা আমার একার না। আমিই শুধু জাফর সাহেবের কাজ করিনি, আরো অনেকেই করেছেন।’

জাফরকে পুলিশ গত এপ্রিলে রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তিনি কাশিমপুর কারাগারে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে চকরিয়া থানায় তিনটি হত্যাসহ আটটি মামলা রয়েছে। কারাগারে থাকায় জাফর আলমের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।