Image description
ইসলামিক ফাউন্ডেশন , ১৫ বছরে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে (ইফা) গত ১৫ বছরে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই সময়ে অন্তত হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) সামীম মোহাম্মদ আফজালের ১১ বছরের সময়কালে বেশির ভাগ দুর্নীতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন।

২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ অডিট রিপোর্টে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার অপব্যয় এবং অবৈধ খরচের তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে সরকারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়েছে ৫১৮ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ১৩৪ খাতে এসব অনিয়ম করা হয়েছে। আজও সেই অডিট আপত্তির নিষ্পত্তি হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও রাজনৈতিক প্রভাবই ছিল প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীরকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সাখাওয়াত হোসেন এবং সদস্যসচিব প্রতিষ্ঠানটির সচিব মো. ইসমাইল হোসেন। কমিটিকে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সামীম মোহাম্মদ আফজাল ২০০৯ সালের শুরুতে নিয়োগ পেয়ে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব খাতভুক্ত প্রথম শ্রেণির ১২টি পদে ৪৭ জনকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি করে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগে কোনো বিধি-বিধান মানা হয়নি।

তদন্তের বিষয়ে ইফার ডিজি আ. ছালাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কমিটির সদস্যসচিব হজ টিমে সৌদি আরবে আছেন। হজ শেষে ফেরার পর তদন্ত শুরু হবে। তাঁদের সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়।’ 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালের ওই নিয়োগের সুপারিশপত্রে সই করেননি কমিটির সদস্যসচিব, জনপ্রশাসন, অর্থ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি। লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তদের মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানো এবং সর্বনিম্ন নম্বরপ্রাপ্তদের সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়া হয়েছে। নিয়োগের যোগ্যতা ছিল ছাত্রলীগের পরিচয়। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকেই আটজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ কমিটির প্রভাবশালী দুই সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও সামীম আফজালের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এই নিয়োগের সিলেকশন কমিটির কার্যবিবরণী ঘেঁটে পাওয়া গেছে নানা অনিয়ম, যা কালের কণ্ঠের কাছে সংরক্ষিত আছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজিকে সভাপতি, সচিবকে সদস্যসচিব ও বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের পাঁচজন সদস্য এবং তত্কালীন ডিজির অনুগত ছয় পরিচালক নিয়ে গঠিত হয় নিয়োগ কমিটি। এই কমিটির সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী। বর্তমানে তিনি কারাবন্দি। গোলাম মওলা নকশেবন্দী ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। বর্তমানে তিনি পলাতক।

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী ছিলেন গত ১৫ বছর ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তিনিও পলাতক। সিরাজউদ্দিন আহমেদ ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েও পাননি। আওয়ামী লীগপন্থী সচিব আজিজুর রহমান মারা গেছেন। ডিজিসহ এই পাঁচজন নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগের সুপারিশপত্রে সই করেন। আবার বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের সভায় উপস্থিত থেকে তাঁরাই ওই সুপারিশ অনুমোদন করেন।

এ ব্যাপারে নিয়োগের সুপারিশপত্রে স্বাক্ষরকারী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্কালীন পরিচালক ডা. খিজির হায়াত খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই নিয়োগটি নিয়ম মেনে করা হয়নি। এ নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক ছিল।’

এই নিয়োগ ছিল পুরোপুরি দলীয়। নিয়োগ পাওয়া সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। মশিউর রহমান ভূঁইয়া, তহমিনা ইয়াসমিন ও মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। রিজাউল করিম, সাখাওয়াত হোসেন, সাহাবুদ্দিন ও মহিউদ্দিন পাটোয়ারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা, মোস্তাফিজুর রহমান কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা এবং মশিউর রহমান (সমাজবিজ্ঞান প্রশিক্ষক) হাজী দানেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রসেনার কেন্দ্রীয় নেতা মনিরুজ্জামান, জাকের হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও জামাল উদ্দিনকে দলীয় পরিচয় ও সুপারিশে নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে কমপক্ষে আটজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন সহকারী পরিচালক সুজন আহমেদ চৌধুরী, ফারুক আহমেদ, মনিরুজ্জামান, আশেকুর রহমান, সৈয়দ সাবিহা ইসলাম, তহমিনা ইয়াসমিন (মৌলভীবাজার জেলা কোটায় নিয়োগকৃত), ফাহমিদা বেগম (কক্সবাজার জেলা কোটায় নিয়োগকৃত) এবং উত্পাদন ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগকৃত শাহ আলম। এ ছাড়া সহকারী পরিচালক চাঁদপুরের আবদুল্লাহ আল মামুনকে গাজীপুর জেলা কোটায় চাকরি দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশন জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি এম এ বারী বলেন, ‘এই নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। মৌখিক পরীক্ষায় পেন্সিল দিয়ে নম্বর দেওয়া হয়, নম্বরপত্র ঘষামাজা করা হয়। অনেকের শিক্ষা সনদ ও অভিজ্ঞতার সনদ জাল। অনেককে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অবিলম্বে এই নিয়োগ বাতিল করা উচিত।’

জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে যাঁরা প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ মানুষকে হতাশ করবে। ইফার দুর্নীতি নিয়ে বহু প্রতিবেদনও হয়েছে, কিন্তু কার্যকর তদন্ত হয়নি। যাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে এবং অডিটে ধরা পড়েছে, তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’

নিষ্পত্তি হয়নি অডিট আপত্তি : সাবেক ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের সময়ে বিধিবহির্ভূত নিয়োগ ও পদোন্নতি, প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ ফেরত না দিয়ে বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন, কেনাকাটায় অনিয়ম, অনুমোদন ছাড়া পেনশন ফান্ডে টাকা স্থানান্তরসহ ইফার বিভিন্ন কার্যক্রমে নানা অপকর্মের অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালের ৮ জুলাই পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ নিরীক্ষা দল গঠন করে সিভিল অডিট অধিদপ্তর। ৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত এই নিরীক্ষা চলে। অডিট অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম নিয়ামুল পারভেজের নেতৃত্বে এই টিমের অন্য সদস্যরা হলেন অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম, মো. শফিকুল ইসলাম, অডিটর মো. মফিজুল ইসলাম ও মো. ইমাম হোসেন।

এই টিম কর্তৃক এক মাসের নিরীক্ষায় ইফার বিভিন্ন প্রকল্পসহ ব্যয়ের অনেক খাতেই অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়ে। ১৮৬ পৃষ্ঠার প্রাথমিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ১৩৪টি খাতে ২০০৯-২০১৮ অর্থবছরের প্রাথমিক অনুসন্ধানে মেলে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ সময় তড়িঘড়ি করে মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্পের অব্যয়িত ৭৪ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়।

বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সরাসরি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে—এমন খাতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আর্থিক বছরের শেষ দিনে প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে ৬৪ জেলায় অর্থ ছাড় করা হয় ৩১ কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ২২০ টাকা, যা অনিয়ম। আর্থিক বছর শেষে প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে না দেওয়ায় ক্ষতি ১৭ কোটি ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫৭৩ টাকা। গণশিক্ষা কেন্দ্রের জন্য পাঠ্যবই মুদ্রণে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ২০ কোটি ৯৮ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৭ টাকা এবং কোরআনুল কারিম মুদ্রণে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে অতিরিক্ত মূল্যে কার্যাদেশ দেওয়ায় ১২ কোটি ৩৫ লাখ ৮১ হাজার ৪১৭ টাকা ক্ষতি হয়েছে। কার্যাদেশের পরিমাণের চেয়ে কম কোরআন শরিফ নেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে তিন কোটি ৩২ লাখ ৮২ হাজার ৬০০ টাকা। বোগদাদিয়া কায়দায় ক্ষতি এক কোটি টাকা। জিওবির বরাদ্দের অব্যয়িত টাকা জমা না দেওয়ায় ২২ কোটি ৯ লাখ ২৭ হাজার ৫০৯ টাকা এবং সিপিটিইউয়ের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন ছাড়াই বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানকে ১৬ কোটি ৩০ লাখ ১০০ টাকা দেওয়া হয়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন খাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে ৫১৮ কোটি টাকা তছরুপ করা হয়েছে। এসব খাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ১৩৭ কোটি ৬৬ লাখ ২০ হাজার ৮৫৭ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ইফার পেনশন ফান্ডে ১৪১ কোটি ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ৩৮ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে।