Image description
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ড

নিজের রক্ষায় অন্তবর্তীকালিন সরকারের কতিপয় উপদেষ্টা, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারস্থ হচ্ছেন ডিএমপির ছাত্র-জনতা হত্যার সাথে জড়িত ৪৮০টি মামলার আসামিরা। গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানীর ৩৯টি থানায় হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে এসব মামলা দায়ের করা হয়। এ সব মামলার বেশিরভাগ আসামিই আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। আসামিদের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, আমলা, শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র শিল্পীরাও রয়েছেন। তবে এসব মামলার অধিকাংশ আসামি এখনও গ্রেফতার হয়নি। এমনকি গত ১০ মাসে একটি মামলারও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি মামলার সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা। অভিযোগ রয়েছে আসামিদের রক্ষায় সরকার ও পুলিশের একটি প্রভাবশালী চক্র নেপথ্যে কাজ করছেন। ফলে মামলার তদারকি ও তদন্তের সাথে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা ধীরগতিতে তদন্ত করছেন।

ডিএমপির আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি মো. তারেক জুবায়ের বলেন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের বিশেষ মনিটরিং সেলের মাধ্যমে জুলাই-আগস্ট হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাগুলোর তদন্তকাজ চলছে। সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্তের কাজ আগানোর কথা শুনেছি। অনেক মামলার কাজ শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। শিগগিরই সেগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগের এই কর্মকর্তা।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, আওয়ামী লীগসহ পতিত সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছাত্র-জনতার হত্যা ও হত্যা চেষ্টার মামলার আসামি করা হয়েছে। এসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে রয়েছে প্রচুর টাকা। তারা নিজেদের বাঁচাতে অন্তবর্তীকালিন সরকারের কতিপয় উপদেষ্টা, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। প্রভাবশালীদের মাধ্যমে মামলা থেকে নিজের নাম বাদ দিতে তদ্বির করছেন নানা কায়দায়। কেউ কেউ পুলিশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতেও মরিয়া। এ সব মামলার তদারকি ও তদন্ত কর্মকর্তারা এ জন্য চাপের মধ্যে রয়েছেন বলে ওই কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ৩৯টি থানায় গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জুলাই আন্দোলনকেন্দ্রিক মামলা হয়েছে ৪৮০টি। এর মধ্যে গুলশান থানায় ১৫, বনানীতে ১০, বাড্ডা ও ভাটারায় ৭১, সূত্রাপুরে ৬, গেন্ডারিয়া ১, নিউমার্কেট ৯, কলাবাগান ৩, খিলক্ষেত ৩, ক্যান্টনমেন্ট ৩, রামপুরা ২১, সবুজবাগ ২, মোহাম্মদপুর ৪৩, আদাবর ১৫, তেজগাঁও ৫, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ১, হাতিরঝিল ১৯, কাফরুল ১৩, পল্লবী ৫, রূপনগর ১, মতিঝিল, পল্টন, শাহজাহানপুরে ১৫, যাত্রাবাড়ী ১২২, ডেমরা ১, খিলগাঁও ১৪, মুগদা ৬, মিরপুর ও শেরেবাংলা নগর থানায় ৬১ থেকে ৬৫, লালবাগ, চকবাজার ও কামরাঙ্গীরচর ১৩, উত্তরা পূর্ব ২৮, পশ্চিম ৪২, শ্যামপুর ৫, কদমতলী ২০, ধানমন্ডি ও হাজারীবাগে ২৩ করে এবং বিমানবন্দর থানায় ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট মো. রায়হান হোসেন সাদ্দাম চিকিৎসার জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে যান। সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে ছুটে যান মুগদা হাসপাতালে। ওই দিনই বিকাল সাড়ে ৫টায় স্ত্রীকে ফোন করে মুগদা হাসপাতালের সামনে ব্যাপক সংঘর্ষের কথা জানান। এরপর পরিবারের সদস্যরা বারবার কল দিলেও রায়হানের নম্বরটি বন্ধ পান। পরে ৫ আগস্ট দিবাগত রাত ৩টার দিকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা একটি প্রাইভেটকার থেকে রায়হানের লাশ হাতিরঝিল ব্রিজের ওপরে ফেলে যায়। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতের চিহ্ন দেখা যায়। এ ঘটনার পর গত ১৯ আগস্ট হাতিরঝিল থানায় দুইজনকে এজাহারভুক্ত ও অনেককে অজ্ঞাতনামা আসামি করে হত্যা মামলা করেন নিহতের পিতা মো. সালাউদ্দিন। ওই মামলায় এখন পর্যন্ত একজন আসামিও গ্রেফতার হয়নি। মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক সাদ্দাম হোসেন বলেন, মামলার তদন্তকাজে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে এ ভিকটিমকে কে বা কারা হত্যা করেছে, সে বিষয়ে কোনও কিছু খুঁজে পাইনি। মামলার এজাহারভুক্ত দুজন আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তারা দুজনই ভারতে আছেন। আমরা বেশ কিছু আলামত পেয়েছি, আবার কিছু আলামত হারিয়ে গেছে। এ মামলার চতুর্থ তদন্ত কর্মকর্তা আমি। লাশ যে কার্পেটে মোড়ানো ছিল, সেই কার্পেট পরে আর আমি পাইনি। এরপরও ঊর্ধ্বতন স্যারদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি। তদন্ত কবে শেষ হবে, এখনই বলতে পারছি না।

পুলিশ কর্মকর্তা ময়নালের ছেলে ইমাম হোসেন তাইম। নারায়ণগঞ্জের আদমজী সরকারি এম ডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। গত বছরের ২০ জুলাই দুপুরে দিকে কারফিউ শিথিলের সময় কাজলার ফুট ওভারব্রিজ এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে চা খেতে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। তখন রাস্তায় বিক্ষোভ করছিল ছাত্র-জনতা। তাদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, বুলেট ও গুলি ছুড়ে পুলিশ। প্রাণভয়ে দৌড়ে দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে সাটার লাগিয়ে দিয়েছিলেন ১৯ বছর বয়সী তাইম। সাটারের নিচে আধা হাত খোলা থাকায় পুলিশের নজরে পড়েন তাইম ও তার বন্ধুরা। পুলিশ তাদের মারধর করে দৌড়ে পালাতে বলেন। ভয়ার্ত হৃদয়ে পুলিশের দিকে তাকিয়ে পালানোর সময় পেটে কয়েকটি গুলি লাগে তাইমের। তার বন্ধু এসে তাকে হাত ধরে টেনে নেওয়ার সময় আবারও তাকে গুলি করে পুলিশ। পরে নিথর দেহটি ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের মা পারভীন আক্তার ২১ আগস্ট তৎকালীন যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ পরিদর্শক জাকির হোসেনসহ ৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় এজাহারভুক্ত তিন ও অজ্ঞাতনামা একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. রমিজুল হক বলেন, মামলা তদন্তের জন্য আমরা সেখানকার ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। হেলমেট পরা থাকায় সবাইকে সেভাবে শনাক্ত করা যায়নি। দেহের অন্যান্য অবয়ব দিয়ে তাদের শনাক্ত করার চেষ্টায় আছি। এ মামলায় আমরা ২৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে সাজ্জাদ নামে পুলিশের একজন উপপরিদর্শককে গ্রেফতারও করেছি। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের জন্য র‌্যাবকে জানিয়েছি। মামলার তদন্ত চলমান আছে। কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। আরও অনেক তথ্যই পাইনি। তদন্তকাজ শেষ হতে আরও সময় লাগবে।

গতবছরের ১৯ জুলাই নিউমার্কেট থানার এলিফ্যান্ট রোডের গলির মাথায় আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পর গুলিতে নিহত হন তরুণ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়। এ ঘটনায় গত বছরের ২১ আগস্ট নিউমার্কেট থানায় ৭ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা আরও ৩০ থেকে ৪০ জনকে আসামি করে মামলা করেন নিহতের মা সামসি আরা জামান। এর মধ্যে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে কারাগারে আছেন। বাকিদের গ্রেফতার করা যায়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মারুফ হাসান বলেন, মামলাটির তদন্তকাজ আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমাদের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালও এ মামলা তদন্ত করছে। আমরা সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করেছি। আসামিদের শনাক্ত করেছি। ৪০ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। ঈদের পর এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো। এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি বলেন, এজাহারভুক্ত আসামি হলেই দোষী বিষয়টা এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে যারা দোষী, আমরা তাদের শনাক্ত করেছি। তাদের শিগগিরই গ্রেফতার করা হবে।