
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধপূর্ণ একটি দ্বীপ হলো দক্ষিণ তালপট্টি। দ্বীপটি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দীর্ঘ চার বছর পর্যন্ত উত্তেজনা ছিল। এমনকি এই দ্বীপটি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত প্রায় যুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থায় চলে গিয়েছিল। ১৯৮১ সালে ভারত এই দ্বীপ দখল করার জন্য যুদ্ধজাহাজ পাঠায়। তবে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায় ভারতের সেই জাহাজ। মূলত, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দৃঢ়তায় দ্বীপটি ভারতীয় দখলমুক্ত হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ভূকৌশলগত দিক দিয়ে তালপট্টি দ্বীপ বাংলাদেশ ও ভারতের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারত যদি এই দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে, তাহলে বাংলাদেশের সমগ্ৰ উপকূলে বিনা বাধায় নজরদারি চালাতে পারবে। এ ছাড়া ভূ-বিশ্লেষকরা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মাটির নিচে বিপুল পরিমাণ গ্যাস-কয়লা ও খনিজসম্পদ মজুত থাকার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। আর এই বিপুল পরিমাণ খনিজসম্পদ এবং বিশাল ভূখণ্ডই মূলত দুই দেশের আগ্ৰহের মূল কারণ।
তালপট্টি দ্বীপ নিয়ে বিবাদ মীমাংসার জন্য ১৯৭৯ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে ভারতে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দ্বীপটি বাংলাদেশের দাবি করে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও স্যাটেলাইট ছবি পেশ করেন। এরপর দুই দেশের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, এসব তথ্য-উপাত্ত স্টাডির ওপর ভিত্তি করে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা সমস্যার সমাধান করতে রাজি হয় দুই দেশ। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা বাদ দিয়ে হঠাৎ দ্বীপ নিজেদের দখলে নিতে সেনা পাঠায়। ১৯৮১ সালের ১১ মে ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে আইএনএস সন্ধ্যায়ক নামে যুদ্ধজাহাজ পাঠায় এবং ভারতীয় সেনারা সেখানে একটি নৌঘাঁটি স্থাপন করে। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে উড়তে থাকে ভারতীয় পতাকা ।
এই ঘটনার দুদিন পর অর্থাৎ ১৩ মে ভারতীয় দখলদারদের প্রতিরোধ করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দুটি যুদ্ধজাহাজ পাঠায় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভারতীয় সেনা চৌকিতে অতর্কিত হামলা চালায়। এভাবে বাংলাদেশ ও ভারতীয় নৌবাহিনী তিনদিন পর্যন্ত মুখোমুখি অবস্থান করছিল। অবশেষে রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে ভারত সেখান থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশের কঠোর মনোভাব দেখে ভারত দক্ষিণ তালপট্টি থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে দ্বীপটিকে নোম্যান্স ল্যান্ড ঘোষণা করে।
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের জেলেরা। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে এই দ্বীপটির সন্ধান পান তারা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সুন্দরবনের জেলেরা প্রথম তালপট্টি দ্বীপটির অস্তিত্বের কথা প্রচার করে বাংলাদেশের দক্ষিণে বৃহত্তর খুলনা জেলার কালীগঞ্জ শ্যামনগর থানার দক্ষিণে অবস্থিত হওয়ায় দ্বীপটিকে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ নামে অবহিত করে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশি জেলেদের আবিষ্কার করা এই দ্বীপের খবর ভারতেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের এই দ্বীপটি ভারতের অংশ বলে ব্যাপকভাবে প্রোপাগান্ডা চালাতে থাকে। এর কিছুদিন পর ভারত সরকার নতুন এই দ্বীপটিকে নিউমুর দ্বীপ বলে ঘোষণা করে।
কলকাতার সংবাদপত্রগুলোতে দ্বীপটিকে কখনো নিউমুর কখনো পূর্বাশা বলে প্রকাশ করতে থাকে। এরপর বাংলাদেশে দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার পালাবদল দক্ষিণ তালপট্টিকে আলোচনায় আসতে দেয়নি। তবে দীর্ঘ অপেক্ষার পর বাংলাদেশ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সীমানা বিরোধ মীমাংসা আদালতে বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপসহ ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার কর্তৃত্ব দাবি করে মামলা করে। এরই মাধ্যমে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের ব্যাপারে একটি ফয়সালার আশায় বুক বাঁধে দুই দেশ। তবে ২০১০ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, বৈষয়িক উন্নয়নের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর এমন উচ্চতায় পৌঁছে যে আসলে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব এখন আর নেই। দ্বীপের সম্পূর্ণ অংশ সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে গেছে।
অন্যদিকে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বিরোধপূর্ণ সীমানা মীমাংসা আদালত ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয়। তবে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ পূর্বে যেখানে ছিল সেই অংশ ভারতের পক্ষে বলে রায় দেয় আদালত। এটা তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে যেহেতু দ্বীপের অস্তিত্বই আর নেই সেই অংশে ভারতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়।
তবে অনেক সমুদ্র বিশেষজ্ঞদের মতে, তালপট্টি দ্বীপের এখনো অস্তিত্ব রয়েছে। তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব নিয়ে ভারত মিথ্যাচার করছে। এ ছাড়া ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ভারত সুন্দরবন-সংলগ্ন দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি কৌশলে ভেঙে দিচ্ছে। বাংলাদেশের সীমানায় বৃহত্তম এই দ্বীপটি যাতে আর গড়ে উঠতে না পারে, সেজন্য ভারত উজানে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর স্রোত ও পলি নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে নতুন করে পলি জমতে না পেরে তালপট্টি দ্বীপ আর উঁচু না হয়ে বরং সম্প্রতি সেখানে ভাঙন শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে পাঁচ-ছয় বছর আগে থেকে ভারত বিশ্বব্যাপী অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে তালপট্টি বিলীন হয়ে গেছে; বর্তমানে এর আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব এখনো আছে এবং ভাটার সময় দ্বীপটির কিছু অংশ জেগে ওঠে কিন্তু জোয়ারে সম্পূর্ণ ডুবে যায়। আগে যত দ্রুত দ্বীপটি গড়ে উঠেছিল বর্তমানে আর সেভাবে গড়ে উঠছে না। তবে বিলীন হয়ে যায়নি। কিছুদিন আগে গুগল স্যাটেলাইট মানচিত্রে তালপট্টি দ্বীপটির অস্তিত্ব দেখা গেছে।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত সমুদ্রবিজ্ঞানী ও ভূগোল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আব্দুর রব বলেন, দ্বীপটি রেকর্ডপত্রে বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারত জোর করে দ্বীপটি দখল করে রেখেছিল। কিন্তু তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দ্বীপটির দখল নিয়েছিলেন। এরপর ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারণসংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসা না হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে সেখানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি করতে দেয়নি। এর মধ্যে ভারত একাধিকবার জরিপ করে দেখেছে তালপট্টি দ্বীপ পুরাপুরি জেগে উঠলে এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমুদ্রসীমার ফয়সালা হলে তারা কখনো তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা পাবে না। বরং বাংলাদেশ এই দ্বীপের মালিকানা লাভ করলে সমুদ্রসীমা আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তাই ভারত তালপট্টি দ্বীপটি ভেঙে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছে।
অধ্যাপক ড. আব্দুর রব বলেন, বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা নিয়ে মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের ব্যাপারে সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের (ইটলস) রায়ের পর ভারত আরো হিংস্র হয়ে উঠেছে, যাতে তালপট্টির মালিকানা কোনোভাবেই বাংলাদেশ না পায়। এজন্য একদিকে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় গ্ৰোয়িং নির্মাণ করে স্রোতের গতি বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পলি অন্যদিকে সরিয়ে নিচ্ছে ভারত।
মেরিটাইম বিশেষজ্ঞ ও সমুদ্রসম্পদ পর্যবেক্ষকদের অভিমত, আয়তনের দিক দিয়ে দক্ষিণ তালপট্টি ক্ষুদ্র হলেও ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে দ্বীপটির গুরুত্ব অপরিসীম। উপকূলীয় দ্বীপটির মালিকানার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের বিশাল সমুদ্র অঞ্চলের সার্বভৌমত্বের স্বার্থ। তাই সালিসি নিষ্পত্তির মাধ্যমে শুধু দক্ষিণ তালপট্টি নয়, বরং সমুদ্রসীমার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনকে নিষ্কণ্টক করা একান্ত জরুরি।