Image description

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ সোমবার (৯ই জুন) চারদিনের সরকারি সফরে ব্রিটেনে গেছেন। একে সরকারি সফর বলা হলেও সফরে 'কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড' গ্রহণই সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে, বা ইউনূসের পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টিকে সরকারের পক্ষ থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথা জানিয়েছে। কিন্তু সেটি কবে কখন হবে, তা ড. ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে ঢাকা থেকে বিমান উড্ডয়নের সময়ও চূড়ান্ত হয়নি।

সাধারণত স্বাধীন ও সার্বভৌম কোনো দেশের সরকারপ্রধানের বিদেশ সফর শুরু হওয়ার পর কর্মসূচি চূড়ান্ত না হওয়ার বিষয়টি দেখা যায় না। সফর চূড়ান্ত হওয়ার পরপরই কর্মসূচি নির্ধারিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী এমিরেটস এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট আজ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়ে বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাসসকে জানান।

আজ সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা ঢাকা ছাড়লেও সফরের চূড়ান্ত সূচি তার সফরসঙ্গীদের দুপুর পর্যন্ত দেওয়া হয়নি বলে নিশ্চিত হতে পেরেছে বিবিসি বাংলা। অথচ প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সফরসূচি সম্পর্কে সঙ্গী ও সংবাদমাধ্যমকে আগেভাগেই জানানো হয়। এ সফরে বিটিভি ও পিআইডির প্রতিনিধি নেওয়া হলেও সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের কোনো প্রতিনিধিসহ আর কোনো সাংবাদিককে নেওয়া হয়নি। যা অনেকটা নজিরবিহীন বলে অনেকের কাছে মনে হচ্ছে।

আবার প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের তালিকায় নাম আছে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল মোমেন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের। এটিকেও অনেকে বিরল ঘটনা বলে মনে করছেন। তার বিদেশ সফরে অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের সঙ্গী করার যে অভিযোগ রয়েছে, এবারের সফরও তা থেকে মুক্ত নয়।

জানা যায়, অতীতে দেশের যে কোনো সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান যখন সরকারি সফরে বিদেশ গেছেন, তখন তাদের সফরসঙ্গী হিসেবে সাংবাদিক প্রতিনিধিদের রেখেছেন। সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীদের বিদেশ সফরে সাংবাদিক প্রতিনিধি থাকলে তারা সরকারের কার্যক্রম এবং নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়া জনগণের কাছে তুলে ধরেন। বা, সাংবাদিকরা তাদের সফর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেন, ফলে মানুষ সরকারের কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।

জনগণ বিদেশে সরকারপ্রধান, বা সরকারের প্রতিনিধিদের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য জানতে পারেন, যা তাদের কাজের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। ফলে গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে সরকার ও জনগণের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন হয়। তাই সব সরকারের আমলেই কারো বিদেশ সফরের সময় সাংবাদিক প্রতিনিধিদের রাখা হয়। প্রধান উপদেষ্টার এবারের 'ব্যতিক্রমী' সফরে সাংবাদিকদের কেন রাখা হয়নি, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

অভিজ্ঞদের মতে, সাংবাদিকদের সরকারি সফরে বিভিন্ন কারণে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সাংবাদিকরা সরকারি সফরে জনগণের স্বার্থে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং প্রচারের জন্য যান। সরকারি কোনো সফরে সাংবাদিক প্রতিনিধি না থাকলে তা নিয়ে সফর সংশ্লিষ্ট কেউ চাইলে জনগণের কাছে তথ্য লুকাতে পারেন। বা মিথ্যা প্রচার করতে পারেন।

বাসস অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে উদ্ধৃত করে বলেছে প্রধান উপদেষ্টার 'এ সফরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে ব্রিটেনের সমর্থনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। এর পাশাপাশি পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়টিতে প্রাধান্য দেবে বাংলাদেশ।'

তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সফরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও সেটি কখন হবে তা এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সংসদ সদস্য টিউলিপ সিদ্দিক প্রধান ড. ইউনূসের ব্রিটেন সফরের সময় তার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রস্তাব করে চিঠি দিয়েছেন বলে দ্য গার্ডিয়ান সংবাদ প্রকাশ করেছে। তার প্রেস উইং অবশ্য আগেই জানিয়েছে যে, টিউলিপ সিদ্দিকের কোনো চিঠি তারা পাননি। টিউলিপের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার কোনো বৈঠক  হবে কী না, তার সফরসঙ্গীরা ঢাকা ছাড়বার আগে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি।

গত ২রা জুন দৈনিক কালের কণ্ঠের একটি বিশেষ লেখায় বলা হয়, 'অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই অনেক প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ। তাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে আর এই বিতর্কগুলো তিনি নিজেই সৃষ্টি করছেন। তিনি নিজের স্বার্থ যতটুকু দেখছেন, জনগণের স্বার্থ ততটা দেখছেন না—এমন অভিযোগ অনেকের।'

এতে আরো বলা হয়, 'এই সময়ের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০ বার বিদেশ সফর (সবশেষ ব্রিটেন সফরসহ ১১ বার) করেছেন। বিশ্বের উন্নত দেশ, যারা বিশ্বকূটনীতিতে নেতৃত্ব দেন, যাঁরা বিশ্বের মুরব্বি, তাঁদের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরাও ১০ মাসে এতবার বিদেশ সফর করেননি। সে ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা নিঃসন্দেহে একটি অনন্য রেকর্ড স্থাপন করেছেন। কিন্তু এসব সফরে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হয়েছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।'

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টার ব্রিটেন সফরে সাংবাদিক প্রতিনিধিদের না রাখার বিষয়টি শুধু বিরল ঘটনার উদাহরণ হয়েই থাকবে না, তা অনেক বিতর্কের জন্ম দেবে।