
দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের সিংহভাগই আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোটগ্রহণ চেয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার সমসাময়িক পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য ত্রয়োদশ নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিকদের মতামত চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দলগুলো স্ব স্ব অবস্থান সরকারের কাছে পরিস্কার করে। সরকার প্রধানের সঙ্গে দলগুলোর যৌথ ও পৃথক সভা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচী ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
দেশের বৃহত্তর ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার প্রধানের সঙ্গে যতবারই বৈঠক করেছে ততবারই ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরা হয়েছে। চলমান সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে এসেছে বিএনপি। দলটির বক্তব্য হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অবশ্যই ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে এবং এটি সরকারের পক্ষ অসম্ভবও নয়। বিএনপির সঙ্গে আরও অন্তত ৩৬টি রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি জানিয়েছে। এছাড়াও ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাম গণতান্ত্রিক জোটের অবস্থান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে। অন্যদিকে দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ফেব্রুয়ারি ২০২৬ এর মধ্যে (আগামী রোজার আগে) অথবা এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছে। দলটির ভাষ্য, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া। গত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের দু’দিন আগে ৪ জুন বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন থেকে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান। ওই সময় তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, তার দল ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ রোজার আগে নির্বাচন চেয়েছে, সর্বোচ্চ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের ক্ষেত্রে ভষবীরনষব (নমনীয়) থাকবে জামায়াত। তিনি এও বলেন, নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যারা স্টেইকহোল্ডার (অংশীজন) তাদের সক্ষমতা থাকলে ডিসেম্বরের আগেও (এখনই) ভোট হলে অংশ নিতে প্রস্তুত তার দল। অন্যদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি) সংস্কার এবং গণহত্যার বিচার শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়।
গত ৬ জুন শুক্রবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য যে সময়সীমা জানিয়েছেন তাতে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই ক্ষুব্ধ। ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময়ের কথা জানান। ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তালিকায় থাকা (জামায়াত ছাড়া) ৪৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩৬টি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোট চেয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে এপ্রিলের প্রথমার্ধে ভোটের ঘোষণা জামায়াত ও এনসিপি সন্তোষ প্রকাশ করলেও বিএনপিসহ বাকী দলগুলো নাখোশ, এর যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে দলগুলো কাছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যেখানে ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোট দাবি করেছে সেখানে ভোটে তারিখ এপ্রিলে নিয়ে যাওয়ার কী যুক্ত থাকতে পারে? রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরে ভোট অনুষ্ঠানে নানা যুক্তি তুলে ধরেছে। কিন্তু এর বিপরীতে সরকারের তরফ থেকে ডিসেম্বরে ভোট না করার কোনো যুক্তি তুলে ধরা হয়নি। আবার এপ্রিলেই কেন ভোটগ্রহণ করতে হবে এরও কোনো যুক্তি তুলে ধরা হয়নি প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে।
এদিকে, বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই যুক্তি দেখিয়েছে এপ্রিল ভোটগ্রহণ করতে গেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হওয়া আশঙ্কা রয়েছে যথেষ্ট। কারণ, এপ্রিলের শুরু থেকে দেশে আবহাওয়া স্থিতিশীল থাকে না। এপ্রিল ভোট হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কার কথা জামায়াতের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে। অন্যদিকে, দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এপ্রিলে কখনো মৃদু আবার কখনো তীব্র তাপপ্রবাহ থাকে। এপ্রিলের শুরু থেকে দেশজুড়ে বৃষ্টি এবং ঝড় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ এবং এর মাধ্যমে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় হওয়ারও শঙ্কা থাকে। এছাড়াও বজ্রবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় এবং তীব্র কালবৈশাখীর ঝড় হওয়ারও শঙ্কা থাকে এপ্রিল মাসে। ফলে আবহাওয়ার দিক বিবেচনায় এপ্রিল কোনোভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত সময় নয়। তাছাড়া এপ্রিলে পাবলিক পরীক্ষাও রয়েছে। দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোজার পরেই নির্বাচনে অংশ নিতে হলে রোজার মধ্যে নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে হবে, যা অসম্ভব এবং অযৌক্তিকও বটে!
গত ৬ জুন প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে ডিসেম্বরের পরিবর্তে এপ্রিলে ভোটগ্রহণের সময় নির্ধারণ কার স্বার্থে করেছেন এমন প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। দলটির সর্বোচ্চনীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আজ তার চট্টগ্রামের বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রশ্ন তুলেন নির্বাচন পেছালে কার লাভ, কার জন্য সরকার নির্বাচন পেছাতে চায়? কাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে? তিনি বলেন, সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আগামী ডিসেম্বরকেই নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময় বিবেচনা করে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে বলা হয়েছে। এপ্রিলে ভোট করতে গেলে রোজার মধ্যে প্রচার চালাতে হবে, রোজা রেখে যা সম্ভব নয়। তাছাড়া রোজার পর পাবলিক পরীক্ষা এবং এপ্রিলে থাকে প্রাকৃতি দুর্যোগ। এ সময় (এপ্রিল) ভোটের সময় নির্ধারণের কী যুক্তি থাকতে পারে বলেও প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক।
প্রসঙ্গত, কোরবানির ঈদের আগের দিন গত ৬ জুন শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, ‘বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যে কোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে।’ তার ভাষণের পরপরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল স্ব স্ব প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করে। ছোট দলগুলো এককভাবে এবং জোটগতভাবেও প্রতিক্রিয়ায় জানায়। প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত ও এনসিপি ছাড়া বাকী প্রায় সব দলই এপ্রিলে ভোটগ্রহণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তারা ডিসেম্বর বা এর কাছাকাছি সময়ে ভোট গ্রহণের পক্ষে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, দেশবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্খা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন। অধিকাংশের মতামতের প্রতি সম্মান জানিয়ে পুনরায় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে একটি পরিচ্ছন্ন, উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণের পরিবেশ চায় দেশবাসী।
শীর্ষনিউজ