
গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাবেক মন্ত্রী, আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর অন্তত ১০ জন সাবেক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগ এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালাচ্ছে সংস্থাটি। কিছু অভিযোগে ইতোমধ্যে মামলা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। পাশাপাশি অনেকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে।
তাদের মধ্যে সাবেক সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, দপ্তর ও অধিদপ্তরে দায়িত্ব পালন করা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা রয়েছেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে তাদের অনেকের হদিস মিলছে না। তাদের ব্যবহৃত ফোন নম্বর ও হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করলেও সাড়া মেলেনি।
দুদক বলছে, অভিযোগের প্রতিটি ঘটনায় দুদকের অন্তত তিনজন করে কর্মকর্তা তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন। তাদের অনেকের সঙ্গে আলাপের চেষ্টা করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তবে তদন্তাধীন কোনো বিষয়ে কথা বলতে চাননি কেউই।
দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেসব অভিযোগ এখন অনুসন্ধানাধীন, সেগুলোর কার্যক্রম নিয়মমাফিক এগোচ্ছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করছেন। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করছেন।
‘অনুসন্ধান শেষ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা দল কমিশনে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে। এরপর সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই কমিশন পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।”
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ। সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং হুন্ডি ও ব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থপাচার করে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ব্যবসা পরিচালনা ও বাড়ি কেনার অভিযোগ ওঠে।

অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আজিজ আহমেদ
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে আমলে নেওয়া এ অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব বর্তেছে দুদকের উপপরিচালক মো. জাকারিয়ার কাঁধে। তাকে দলনেতা করে চার সদস্যের কমিটিতে রয়েছেন- উপপরিচালক রতন কুমার দাস, সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন ও উপসহকারী পরিচালক আফিয়া খাতুন।
আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সেনাপ্রধান ছিলেন। ২০১২-১৬ মেয়াদে বিজিবির মহাপরিচালক ছিলেন। তার মেয়াদের শেষ দিকে আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হলে সরকার ও সেনাবাহিনী প্রতিবাদ জানায়। আজিজ আহমেদও অভিযোগ অস্বীকার করেন। ২০২৪ সালের ২০ মে যুক্তরাষ্ট্র তার ও তার পরিবারের সদস্যদের ভিসা বাতিল করে।
দুদকের এক নথিতে বলা হয়, তিনি রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় শত কোটি টাকার বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং ‘আলিশান বাংলো’ নির্মাণ করেছেন। মিরপুর ডিওএইচএস ও নিকুঞ্জে তার নামে বাড়ি রয়েছে, যার একটি ‘আজিজ রেসিডেন্স’। তার ভাই তোফায়েল আহমেদ ও জোসেফের নামেও ঢাকায় বাড়ি এবং কয়েকশ বিঘা জমি রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুদক।
অভিযোগের বিষয়ে আজিজ আহমেদের ব্যবহৃত ফোন নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান শেখ আব্দুল হান্নান
এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান ২০২১ সালের ১২ জুন বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। মেয়াদ শেষ হয় ২০২৪ সালের ১১ জুন।

অবসরপ্রাপ্ত এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান
তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়, ঘুষ গ্রহণ, নিয়োগ বাণিজ্য, বিভিন্ন অনিয়ম এবং অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান করছে দুদক।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে চলা এ অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুদকের উপপরিচালক তানজীর সরকার। তার সঙ্গে রয়েছেন সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান ভূঁইয়া ও উপসহকারী পরিচালক খায়রুল হাসান।
আব্দুল হান্নান তার সম্পদ অন্যত্র হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন- এমন তথ্যে গত ৬ মে তার সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করতে আদালত আবেদন করে দুদক। পরে তার জমি, ফ্ল্যাট ও ব্যাংক হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেয় আদালত।
জব্দ করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ঢাকার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় ৬৯৯ দশমিক ২৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট (মূল্য ১৩ লাখ টাকা) এবং একই এলাকায় কমন স্পেসসহ ৮২৩ দশমিক ৮৩ বর্গফুটের আরেকটি ফ্ল্যাট (মূল্য ১৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা)। মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় তার স্ত্রীর নামে ২ হাজার ২৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট (মূল্য ৩৭ লাখ টাকা) এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ জমি রয়েছে। মিরপুর সামরিক অফিসার আবাসিক প্রকল্পে একটি নির্মাণাধীন সাততলা ভবন এবং বিভিন্ন ব্যাংকের ছয়টি হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব জব্দের একদিন আগে আদালত শেখ আব্দুল হান্নান ও তার পরিবারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
অভিযোগের বিষয়ে শেখ আব্দুল হান্নানের বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি টি এম জোবায়ের
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল টি এম জোবায়েরের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি বড় অঙ্কের ঘুষ নিয়ে চাকরি দিয়েছেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন করেছেন এবং ২৯ লাখ ৪৫ হাজার পাউন্ড লন্ডনে পাচার করেছেন।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল টি এম জোবায়ের
জোবায়ের ২০১৮ সালে এনএসআইয়ের ডিজির দায়িত্ব পান। টানা ছয় বছর তিনি ওই পদে ছিলেন। তাকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয় ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ।
তার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক মো. মনজুর আলমের নেতৃত্বাধীন দল অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।
গত ২১ এপ্রিল দুদকের আবেদনে জোবায়েরের ট্রাস্ট ব্যাংকের পাঁচটি হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেয় আদালত। এসব হিসাবে ২৬ লাখ পাঁচ হাজার ৮০১ টাকা রয়েছে।
আদালতে দুদকের আবেদনে বলা হয়, ট্রাস্ট ব্যাংকের পাঁচ হিসাবের মাধ্যমে টি এম জোবায়ের ও তার স্ত্রী ফাহমিনা মাসুদ অবৈধ অর্থ স্থানান্তর করতে পারেন। এ কারণে জোবায়েরের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা প্রয়োজন।
এর আগে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর জোবায়ের ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত।
অভিযোগের বিষয়ে টি এম জোবায়েরের বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান
রাজউকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. সিদ্দিকুর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে পূর্বাচল নতুন শহরসহ বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ আত্মসাৎ এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক অনুসন্ধান শুরু করেছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ নামে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন– তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান পরিচালনার জন্য দুদকের পরিচালক আবুল হাসনাতকে প্রধান করে একটি তিন সদস্যের দল গঠন করা হয়েছে। অন্য দুই সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক বিষাণ ঘোষ ও উপসহকারী পরিচালক আফিয়া খাতুন।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. সিদ্দিকুর রহমান
২০২৪ সালের এপ্রিলে সিদ্দিকুর রহমান সরকারকে দুই বছরের জন্য রাজউক চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। তবে ৫ অগাস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর ১৯ সেপ্টেম্বর তার নিয়োগ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে ২২ সেপ্টেম্বর ওই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে তাকে পুনর্বহাল করা হয়। চলতি বছরের মার্চে সরকার পুনরায় তার নিয়োগ বাতিল করে।
দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আবেদনের ভিত্তিতে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল আদালত তার ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, সিদ্দিকুর রহমান ও তার স্ত্রী গাজী রেবেকা রওশন বিদেশে পালানোর চেষ্টা করছেন। তারা যদি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তাহলে চলমান অনুসন্ধান কার্যক্রম দীর্ঘায়িত বা ব্যাহত হতে পারে।
অভিযোগের বিষয়ে সিদ্দিকুর রহমানের বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সামরিক সচিব সালাউদ্দিন
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব.) সালাউদ্দিন মিয়াজীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতির মাধ্যমে ভূমিহীন ও সাধারণ মানুষের জমি দখল করে যশোরের চাঁচরা ইউনিয়নে ৪০০ বিঘা জমির ওপর অবৈধভাবে পার্ক নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে।
দেশের অনেক স্থানে শত শত বিঘা জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে চলতি বছরের মার্চে দুদক তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করে।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সালাউদ্দিন মিয়াজী।
সালাউদ্দিন মিয়াজী ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন।
নির্বাচিত হওয়ার পর তার আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধে যশোরের মহেশপুরে কপোতাক্ষ নদ দখল করে মাছ চাষের অভিযোগ ওঠে। ২০২৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে যশোরের নিজস্ব রিসোর্ট থেকে সালাউদ্দিন মিয়াজীকে যৌথবাহিনী গ্রেপ্তারের পর ওই রাতেই ৩টার দিকে তাকে বিশেষ নিরাপত্তায় ঝিনাইদহ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বিএনপির জেলা কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। পুলিশ তাকে ওই মামলায় দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে। পরে ৩০ এপ্রিল বয়স ও শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় এবং সরকারি হাসপাতালের দেওয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে আদালত তাকে জামিন দেয়।
অভিযোগের বিষয়ে সালাউদ্দিন মিয়াজীর বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান হামিদুল
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করছে দুদক।
এজন্য দুদকের উপপরিচালক আজিজুল হককে দলনেতা করে দুই সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে। দলের অপর সদস্য হলেন মো. মিজানুর রহমান।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হামিদুল হক
দুদকের আবেদনের ভিত্তিতে গত ২১ এপ্রিল আদালত হামিদুল হক ও তার স্ত্রী নূছরাত জাহান মুক্তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দুদকের আবেদনে বলা হয়, অভিযুক্তরা দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন বলে তথ্য রয়েছে। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধান নিশ্চিত করতে তাদের বিদেশে যাওয়া ঠেকানো জরুরি।
১৯৭০ সালে কক্সবাজারে জন্মগ্রহণ করেন হামিদুল হক। সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৮৮ সালে। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৯০ সালের ২২ জুন সেনাবাহিনীর ইনফ্যান্ট্রি কোরে তিনি কমিশন পান। সবশেষ সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং সিলেটের এরিয়া কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
এর আগে পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন তিনি। এ ছাড়া ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কলেজ সেক্রেটারি এবং কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
অভিযোগের বিষয়ে হামিদুল হকের বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
এসএসএফের সাবেক ডিজি মুজিবুর রহমান
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক নিরাপত্তাপ্রধান এবং ক্ষমতার পালাবদলের পর চাকরি খোয়ানো শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের অন্যতম মো. মজিবুর রহমান ও তার স্ত্রী তাসরিন মুজিবের ‘অবৈধ’ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমে দুটি ফ্ল্যাট, ১০টি প্লটসহ দুটি বাড়ির খোঁজ পেয়েছে দুদক।
অনুসন্ধানে নেমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের সম্পদ জব্দ করতে আদালতের অনুমতিও পেয়েছে দুদক। পাশাপাশি তাদের ১৬টি ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মজিবুর রহমান
তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হককে দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দলের অন্য দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক ফেরদৌস রহমান এবং উপসহকারী পরিচালক জুলফিকার।
বরখাস্ত হওয়ার আগে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মজিবুর রহমান আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের (আর্টডক) জিওসি ছিলেন। তিনি এক সময় স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) মহাপরিচালক ছিলেন, যেটি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক মাস পর মজিবুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ওই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর মজিবুর রহমানকে বরখাস্ত করার আদেশ জারি করে।
আর্টডকে দায়িত্ব পাওয়ার আগে মজিবুর রহমান ছিলেন সেনা সদরের কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি)।
হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে আলোচনায় আসা এ সেনা কর্মকর্তা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালকও ছিলেন।
পরে তাকে এসএসএফের মহাপরিচালক করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে সময় তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী
সাবেক এমপি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী
মাসুদের সঙ্গে ফেনীর সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ সাবেক অর্থমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অবৈধ ব্যবসার অভিযোগে ১৬টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।
মাসুদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মোহাং নূরুল হুদাকে দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছেন উপপরিচালক ওমর ফারুক ও সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম।
দুদকে আসা অভিযোগের বিষয়ে মাসুদ উদ্দিনের বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল
গত জানুয়ারিতে প্রায় ৪০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জন এবং ৩৪২ কোটি টাকার ‘অস্বাভাবিক লেনদেনের’ অভিযোগে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দুদক।
দুদক বলছে, সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান তার ‘জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ’ ২২ কোটি ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ১৪২ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। অনুমোদিত সীমা লঙ্ঘন করে নিজ হিসাবে ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার জমা করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা করে স্ত্রী নুসরাত জাহানের ‘সহযোগিতা ও যোগসাজশে’ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তর করেছেন। জিয়াউল আহসানের নামে আটটি সক্রিয় ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১২০ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।

বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান
অনুসন্ধানকালে জিয়াউল আহসানের সম্পদের যে তথ্য দুদক তুলে ধরেছে, তাতে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে মধ্যে তিনি এসব সম্পদ অর্জন করেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংকে তার বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা এবং পাচারের তথ্য পাওয়ার কথাও বলেছে দুদক।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া জিয়াউল সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার ছিলেন। ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালে তিনি র্যাব-২ এর উপঅধিনায়ক হন।
ওই বছরই তিনি পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন এবং র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পান। র্যাবে দায়িত্ব পালনের সময় থেকেই জিয়াউল আহসান হয়ে উঠেছিলেন সংবাদমাধ্যমে পরিচিত নাম।
কর্নেল পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক করে তাকে র্যাবেই রেখে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াউল আহসানকে পাঠানো হয় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) পরিচালকের দায়িত্বে।
পরের বছরই এনটিএমসির পরিচালক করা হয় জিয়াউল আহসানকে। ২০২২ সালে সংস্থাটিতে মহাপরিচালক পদ সৃষ্টির পর তাকেই সংস্থাটির নেতৃত্বে রাখা হয়েছিল।
ক্ষমতার পালাবদলের পর সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে রদবদলের ধারাবাহিকতায় গত ৬ আগস্ট তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় জিয়াউল আহসানকে। আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে গুম, খুন এবং ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া গোপন বন্দিশালায় নির্যাতনে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
২০১৪ সালের ১৬ অগাস্ট গ্রেপ্তারের পর জিয়াউল আহসানকে বিভিন্ন মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাতেও তার নাম এসেছে।
বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন ।
বিজিবির সাবেক ডিজি সাফিনুল
বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক।
এ অভিযোগে গত ৯ মে তাকে ও তার স্ত্রী সোমা ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদও করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ফেরার সময় তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম
তাদের আইনজীবী মিজানুর রহমান সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “ওনারা যা আয় করেছেন, সবই জ্ঞাত উৎস থেকে। কোনো অবৈধ উপার্জন নেই। সাফিনুল ইসলাম একজন সৎ, দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে দেশকে সেবা দিয়েছেন। তাদের সম্পদের হিসাব আয়কর নথিতে উল্লেখ রয়েছে এবং দুদককে তা জানানো হয়েছে।”
‘একটি জাতীয় নির্বাচনে তিনি দায়িত্বে ছিলেন’- এরকম এক প্রশ্নে আইনজীবী বলেন, “উনি শুধু সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার কখনো করেননি।”
সাফিনুল ইসলাম ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ বিজিবির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ এপ্রিল আদালত সাফিনুল ও তার স্ত্রীর ৫৬টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেয়। এসব হিসাবে সঞ্চয়পত্র, স্থায়ী আমানত ও ক্রেডিট কার্ড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তার আগে গত ১৩ মার্চ দুদকের আরেক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ দম্পতির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।