
বাংলাদেশে কুরবানির ঈদ শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি বিশাল সামাজিক উৎসবও বটে। কুরবানির পশু কেনা, পরিচর্যা, মিছিল করে বাড়ি আনা—সবই ঈদের প্রস্তুতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সঙ্গেই জুড়ে গেছে চাটগাঁইয়া সংস্কৃতির এক রসালো ও মজার ঐতিহ্য—‘ভাই, হটিয়া লইয়ে?’—একটি অঘোষিত সামাজিক প্রথা।
কুরবানির ঈদ এলেই দেশের প্রতিটি মহল্লা, হাট ও উঠানে ঘুরে-ফিরে শোনা যায় এই বহুল ব্যবহৃত প্রশ্নটি—“ভাই, হটিয়া লইয়ে?”। গরু দেখা মাত্রই প্রথম যে প্রশ্নটি করা হয়, তা হলো গরুর দাম! যেন এটা ঈদের অনিবার্য এক রেওয়াজ।
সময়ের সাথে সাথে এই সাধারণ প্রশ্নটি আজ আর শুধুই দাম জানার কৌতূহল নয়—এটি হয়ে উঠেছে এক ধরনের সামাজিক তুলনা, কথোপকথনের সূচনা, এমনকি ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার একটি রসিকতাপূর্ণ মাধ্যম।
বিষয়টিকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে একধরনের চঞ্চল রসও। কচিকাঁচারা গরুর বাজারের সড়কে মাতিয়ে তোলে এমন ডাকাডাকি দিয়ে। তারা দল বেঁধে গরুর পেছনে হালকা চাপে আঘাত করে বলে ওঠে—‘হটিয়ে লইয়ে’, ‘দাম হইয়ি’, ‘হত লইয়ে’—এসব শব্দ যেন গরুর বাজারের আলাদা এক প্রাণ। এতে তারা যেমন আনন্দ পায়, তেমনি অন্যরাও উপভোগ করে দৃশ্যপটটি। অনেকের মতে, এটিও ঈদের আগাম আমেজের একটি অংশ।
কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই আচরণের পেছনে রয়েছে মানুষের স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ও নিজেকে মূল্যায়নের প্রবণতা। কার গরু বড়, কারটা দামি, কে কত কমে ভালো গরু কিনেছে, এই সবই হয়ে দাঁড়ায় আলোচনার বিষয়।
কক্সবাজারের স্থানীয় এক বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, ‘আঁই গরু কিনি আইবার সময় বত মাইনষরে গরুর দাম হইয়ি। যেই দেখে ফুচার লই, ভাই দাম হত? চিনা অচিনা বেগ্গুনেই ফুচার গরে। আরতো ও গম লাগে হইতে, বিরক্ত ন অই, বিরক্ত অইবার হতাও ন। দাম হওয়া আর দাম ফুনিবার মাঝে আলাদা ভালো লাগা হাম গরে। আর দাম ন হইলে মনে হদে কিছু এক্কান লুকার।’
অর্থাৎ যার মানে রফিকুল ইসলাম জানান, ‘আমি গরু কিনে আনার পথে অজস্র মানুষকে এর দাম বলেছি। যেই দেখে সেই বলে ‘ভাই, কত নিয়েছে?’। চেনা অচেনা সকলেই এই প্রশ্ন করে। আমারও ভালো লাগে উত্তর দিতে, কখনও বিরক্তিবোধ করিনি এবং করার কথাও নয়। এই দাম জানানো এবং জানার মধ্যেও অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। আর দাম না বললে মনে হয় কিছু একটা লুকানো হচ্ছে!’
তবে অনেকেই মনে করেন, এটি কেবল কৌতূহলের বহিঃপ্রকাশ। ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার একটা মজার মাধ্যম। যদিও কিছু ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন মানসিক চাপ বা অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা তৈরি করতে পারে।
সময়ের পরিক্রমায় হয়তো এই প্রশ্ন থাকবে আরও প্রজন্ম ধরে, বদলে যাবে শুধু গরুর গড় দাম। কিন্তু প্রশ্নটা রয়ে যাবে একই, ‘ভাই, কত নিছে?’
এদিকে কক্সবাজারের ঐতিহ্যে মেজবানি উৎসব কুরবানির ঈদকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। মেজবানি গরুর মাংস, ঈদের দিনে বিশেষত কিছু পরিবার মেজবানি ঝাল মাংস রান্না করে। এছাড়াও কালা ভুনা, ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনের জন্য মাংসের হালিম বেশ জনপ্রিয়।