Image description
 

বাংলাদেশে প্রতি বছর কোরবানির ঈদে লাখ লাখ পশু কোরবানি হয়। এছাড়াও সারা বছর ধরেই দেশে বিভিন্ন ধরনের পশু জবাই হয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে চামড়া উৎপাদন বাড়লেও দিন দিন কমছে রপ্তানি। উল্টো চামড়াজাত পণ্য তৈরির জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে।

 

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার বিস্তারের জন্য ২০১৭ সালে ট্যানারি শিল্পের স্থানান্তর করা হয় সাভারের হেমায়েতপুরে।কিন্তু যে উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলা হয়েছিল, তার কতটুকু পূরণ হচ্ছে- সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। খবর বিবিসি বাংলার।

শিল্প মালিকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়ে না ওঠায় পাওয়া যাচ্ছে না লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনছে না ইউরোপ আমেরিকার ক্রেতারা।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, ‘সাভারে চামড়া শিল্প নগরীতে ১৪২টা কোম্পানি আছে। এই কোম্পানিগুলো একটাও কম্প্লায়েন্স (সুবিধা করতে পারেনি) হতে পারেনি। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে চামড়া রপ্তানি বাড়ছে না।

ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারে যখন চামড়া শিল্প নগরী স্থানান্তর করা হয়েছিল প্রায় আট বছর আগে, তখনই চামড়া শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কমপ্লায়েন্স (দুষণমুক্ত ও মানসম্মত কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন মানদণ্ড অর্জন) ইস্যুর কারণে বাংলাদেশ বিদেশে চামড়া রফতানি করতে পারছে না। বরং চামড়াজাত পণ্য তৈরির জন্য বিদেশ থেকে চামড়া আমদানিও করতে হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, যখন সাভারের হেমায়েতপুরে প্রথমে ট্যানারি স্থাপন হয়, তখন শুরু থেকেই পলিসি লেভেলে গলদ ছিল। এই পলিসিগত কারণেই পরিস্থিতি এখনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির পর থেকে বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানি কমছে। সেই সঙ্গে কমছে রপ্তানি আয়ও। এর পেছনেও বেশ কয়েকটি কারণ উঠে এসেছে। 

কাঁচা চামড়ায় যে সংকট

এবার কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সাভারের বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর কারখানাগুলোতে প্রায় এক কোটি চামড়া সংগ্রহের টার্গেট রয়েছে শিল্প মালিকদের।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোরবানির পশু কাঁচা চামড়া নিয়ে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। কেননা, গত কয়েক বছর ধরে কাঁচা চামড়ার দামের ধারাবাহিক পতন দেখা গেছে।গত কয়েক বছরের মতো এবারও কোরবানির কাঁচা চামড়া নিয়ে সংকট কাটাতে মূল্য বাড়িয়ে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।

প্রতি বছর দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও কাঁচা চামড়া নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ দেখা যায়। কোরবানির সময় কাঁচা চামড়ার সরবরাহ থাকে প্রচুর, কিন্তু তারপরও চাহিদা না থাকার কারণেই মূলত দাম বাড়ে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, এর পুরোটাই নির্ভর করে চাহিদার ওপর। এখন ধরুন মার্কেটে যদি চাহিদা না থাকে তাহলে দাম কীভাবে বাড়বে? যথাযথ দামে শিল্প মালিকরা বিক্রি করতে না পারলে মালিকরাও বা কেন কিনবে?

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, প্রতি বছর চাহিদার ৫০-৬০ শতাংশ চামড়া কোরবানির ঈদে সংগ্রহ করতে হয়।কিন্তু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার পর সেটি বিক্রির জন্য প্রস্তুত করতে বিদ্যুৎ, লবণসহ যে ধরনের সুবিধা প্রয়োজন, তা সাভারের শিল্প নগরীতে অনেক সময় নিশ্চিত করা যায় না। যে কারণে এবারও এ নিয়ে এক ধরনের দুশ্চিন্তা রয়েছে।

বড় ইস্যু কম্পায়লেন্স

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, গত বছর কোরবানির ঈদের সময় যে চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন ট্যানারি মালিকরা, তার ২৫–৩০ শতাংশ এখনো বিক্রি হয়নি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি'র তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চামড়া রপ্তানি ৮.২৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০৭.৬১ মিলিয়ন ডলারে, যা গত অর্থবছরে ছিল ১১৭.২৭ মিলিয়ন ডলার।

চামড়া খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ও পণ্য উৎপাদনে পরিবেশসম্মত কমপ্লায়েন্স না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমছে।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব মতে, ২০১৭ সালের পর থেকে চামড়া খাতে এক ধরনের ধস নামতে শুরু করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৩-১৪ এর পরে আগে যেমন গার্মেন্টেস কমপ্লায়েন্স কোনো ইস্যু ছিল না, রানা প্লাজার পর ইস্যুগুলো সামনে এসেছে।

কমপ্লায়েন্স ইস্যু হলো এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে একটি কোম্পানি বা ব্যক্তি আইন, প্রবিধান, শিল্পের মান বা অভ্যন্তরীণ নীতিগুলো মেনে চলতে ব্যর্থ হয়।

বিশ্লেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান  বলেন, লেদার ও ট্যানারি সেক্টরে কমপ্লায়েন্স একটি বড় ইস্যু। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। সেখানে যদি কম্প্লায়েন্স না থাকে, তাহলে আমাদের প্রবেশের কোনো স্কোপ (সুযোগ) নাই।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারি শিল্প নগরীতে কঠিন বর্জ্যের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে এই খাত থেকে আয় দিন দিন কমছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, সাভারে মোট ১৪২টা কোম্পানি আছে। এই কোম্পানিগুলো একটাও কমপ্লায়েন্স হতে পারেনি। যে কারণে এক্সপোর্ট গ্রোথ বাড়ছে না। ফলে ইউরোপ আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য দেশগুলো আমাদের এখান থেকে পণ্য কিনছে না।

এই খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ চামড়ার সরবরাহ থাকে। শুধু কমপ্লায়েন্স না থাকার কারণে ভারত ও চীন থেকে চামড়া আমদানি করছে ইউরোপ- আমেরিকার ক্রেতারা।

সংকট কাটবে কবে?

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, প্রতি বছরই একটু একটু করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমছে। সর্বশেষ গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৯৮০ মিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

সংগঠনটির সভাপতি শাহিন আহমেদ জানান, ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি যখন সাভারে যায় ওই বছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ আয় করেছিল দেড় বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে সেটি কমে নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৭৫ বিলিয়ন ডলারে। এক্সপোর্ট ঠিকই হচ্ছে কিন্তু অ্যামাউন্টে গিয়ে এটা কমে যাচ্ছে। এটার একটা কারণ আমরা নন কম্প্লায়েন্স বায়ারদের কাছে সেল করছি।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, সাভার শিল্প নগরীতে হাজার কোটি বিনিয়োগ রয়েছে ব্যবসায়ীদের। কিন্তু সেখানে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মান মাত্রা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে একটা সংকট থেকেই যাচ্ছে।

একদিকে যেমন কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে চামড়াজাত পণ্য তৈরি করতে বিদেশ থেকে উল্টো চামড়া আমদানিও করতে হচ্ছে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোকে। যে কারণে পোশাক শিল্পের পর একটা সম্ভাবনা খাত থাকলেও চামড়া শিল্পে বাংলাদেশ দিন দিন পেছনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম মুশফিকুর রহমান মাসুদ বলেন, বাংলাদেশে চামড়ার যে মার্কেট এটা আসলে ফিক্সড। আমরা এক্সপোর্ট করতে পারছি না কারণ আমাদের ইটিপি কমপ্লিট না, যে জন্য আমরা আমাদের কাস্টমার পাচ্ছি না। যে কারণে বাংলাদেশের ফুটওয়ার কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করছে।

মুশফিকুর রহমান মাসুদ বলছিলেন, বাংলাদেশের ফুটওয়্যার কোম্পানিগুলো প্রত্যেক মাসে আনুমানিক গড়ে ১০-১২ লাখ স্কয়ার ফিট চামড়া শুধু বিদেশ থেকেই আমদানি করছে। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে যদি কমপ্লায়েন্স ইস্যু না থাকতো তাহলে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোকে বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করতে হতো না।

যে কারণে বিশ্লেষকরা এই সংকট কাটতে নীতিতে পরিবর্তন আনারও পরামর্শ দিচ্ছেন।