Image description

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশে কী পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে- এনিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে আলোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। আমার বাংলাদেশ  (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে ‘গত ৮ মাসের আমলনামা’ চেয়েছেন।

এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিডা চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন (আশিক চৌধুরী)।

গত ৮ মাসের আমলনামা প্রকাশ করেছেন তিনি।
সবাইকে বিভ্রান্ত বা ভুল তথ্য না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তথ্য প্লিজ ভেরিফায়েড সোর্স থেকে নিবেন। ভুল তথ্যের শিকার হবেন না। আমাদের জিজ্ঞেস করুন।

আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।’
আজ শুক্রবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দীর্ঘ স্ট্যাটাসে ‘আমাদের আমলনামা’ শিরোনামে বিডার ৮ মাসের তথ্য তুলে ধরেছেন। ডিডা কী নিয়ে কাজ করছে, কাজের অগ্রগতি, যেসব জায়গায় এখনও পিছিয়ে আছে সবকিছুই তার স্ট্যাটাসে তুলে ধরেছেন।

পাঠকদের জন্য আশিক চৌধুরীর পোস্ট তুলে ধরা হলো-

আমাদের আমলনামা ঠিক আট মাস হলো বিডা-বেজায় আজকে।

সরকারের বয়স প্রায় দশ মাস। ব্যারিস্টার ফুয়াদ ঠিকই বলেছেন। একটা আমলনামা দেয়া দরকার। আমরা কি শুধু দুইটা প্রেজেন্টেশন করলাম এতদিন ধরে? কিছু সাংবাদিক, ফেসবুক বিশেষজ্ঞ ও বটদের লেখা পড়লে তাই মনে হয়।  আমাদের রিপোর্ট কার্ডটি শেয়ার করলাম।
ধৈর্য ধরে পড়ার অনুরোধ রইলো। 
আমাদের কাজ মূলত তিনটা এরিয়ায়:
ক. বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে পলিসি ও এক্সিকিউশন এর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া
খ. যারা দেশে অলরেডি বিনিয়োগ করেছেন, তাদের কেস বাই কেস ইস্যু সমাধানের মাধ্যমে এম্বাসেডর তৈরি করা
গ. দেশের ইমেজ ইমপ্রুভ করার পাশাপাশি একটা সলিড ইনভেস্টমেন্ট পাইপলাইন গঠন করা

#ক 
একদম শুরুর দিকে দুইশরো বেশি দেশি-বিদেশী উদ্যোক্তা ও সিইওদের পরামর্শ অনুযায়ী ৩০ টি পদক্ষেপ সনাক্ত করা হয়। তার মধ্যে মোট ১৮ টি নির্দিষ্ট সময়সীমার তুলনায় এগিয়ে আছে, ৭ টি তে আমরা অন ট্র্যাক আছি, ৫ টি তে আমরা প্ল্যান এর থেকে পিছিয়ে আছি। এই প্রগ্রেস আমরা প্রতি দুই মাস পরপর তাদের সাথে 'স্টেট ওফ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট' নামে ওয়েবিনার হোস্ট করে শেয়ার করি। ওয়েবিনার এর লিংকগুলা কমেন্টে আছে। ডিসেম্বর নাগাদ সবগুলা কমপ্লিট করার টার্গেট।

যেগুলোতে রোডম্যাপ / অরিজিনাল টাইমলাইন থেকে এগিয়ে আছি (প্রায়োরিটি অর্ডারে নয়):
১. ইনভেস্টর্স কনসালটেশন: ব্যবসায়ে প্ৰতিবন্ধকতা এবং তার সমাধান সম্মন্ধে তাদের সাথে ডিটেল আলোচনা। 
২. ১০০ টি ইকোনমিক জোনের বদলে ৫ টিতে ফোকাস করা। সেই পাঁচটিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, অন্যান্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার এর একটা রোডম্যাপ পাবলিশ করা। অব্যাবহৃত জমিতে সোলার পার্ক করা। সামরিক শিল্পে সক্ষমতার জন্য একটি মিলিটারি/ডিফেন্স ইকোনমিক জোন চালু করা।
৩. প্রতি মাসে আন্ত-মন্ত্রণালয় কোঅর্ডিনেশন মিটিং চালু করা; ব্যবসা পরিস্থিতি আলোচনা ও সমস্যা সমাধান করতে।
৪. গুরুত্বপূর্ণ বিনোয়োগকারীদের সমস্যা সমাধান করতে আলাদা একটি টিম গঠন করা।
৫. বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস পোর্টাল এর মাধ্যমে পাওয়া সেবার পারফরমেন্স ডেটা (কতগুলো সেবা দেয়া হলো, কার কতদিন লাগলো) বিডার ওয়েবসাইট এ পাবলিক করা।
৬. এফ ডি আই হিটম্যাপ: বাংলাদেশ এ কোন সেক্টরে বিনোয়োগ করা উচিত, কোন সেক্টরে সামনে সরকার পলিসি সাপোর্ট দিবে, এরকম একটা রিসার্চ প্রকাশ করা। এর সিকুয়েল হিসেবে একটি সেমিকন্ডাক্টর টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। আগামী মাসে তারা রিপোর্ট জমা দিবে।
৭. ফরেন কারেন্সি লোন গ্রহণ প্রক্রিয়ার উন্নতি - স্পিড টু  মার্কেট, ফ্লেক্সিবিলিটি, ইত্যাদি।
৮. এনবিআর এ গ্রিন চ্যানেল বা অথোরাইজড ইকোনমিক অপারেটর চালু করা।
৯. এনবিআর এ ডিজিটাল ইনভয়েসিং বা ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো চালু করা।
১০. বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলোর এফিসিয়েন্সি বাড়ানোর জন্য পোর্ট স্ট্রাটেজি নির্ধারণ। এর ধারাবাহিকতায় একটি ফ্রি ট্রেড জোন স্থাপন।  
১১. স্টার্টার প্যাক: ব্যবসা শুরু করার জন্য বেসিক যে কয়টি অনুমোদন লাগে তা একটা ডিজিটাল ফর্ম এ নিয়ে আসা।
১২. বিডাতে একটি দক্ষ রিসার্চ উইং চালু করা 
১৩. এফডিআই প্রোমোশনে সবার জন্য প্রণোদনা বা ইন্সেন্টিভ প্রোগ্রাম চালু করা।
১৪. ঢাকায় একটি ম্যাচমেকিং ইনভেস্টমেন্ট সামিট আয়োজন করা।
১৫. ইনস্টিটিউশনাল এক্সেলেন্স: বিডা-বেজাকে ডি নথিতে এনে সম্পূর্ণ পেপারলেস করা। বিডা-বেজায় ডে কেয়ার চালু করা কর্মচারীদের জন্য। বিডা অফিসে বিনোয়োগকারীদের এবং কর্মচারীদের জন্য ক্যান্টিন, মিটিং ফেসিলিটি চালু করা।
১৬. কমিউনিকেশন স্ট্রাটেজি বা যোগাযোগ কৌশলের উন্নতি: পরিমার্জিত নতুন ওয়েবসাইট - যেটা এই মাসের শেষে লঞ্চ হবে, বিডা ও বেজার সোশ্যাল মিডিয়া প্রেজেন্স (লিংকডইন, এক্স, ফেসবুক, ইত্যাদি), লোগো রিভ্যাম্প, স্টার্টার FAQ, ইত্যাদি।
১৭. এনবিআর, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এর প্রতিনিধি বিডা অফিসে কোলোকেট বা সংস্থাপন করা। প্রত্যেক সরকারি অফিসের ব্যবসায়ীদের জন্য একজন ফোকাল পয়েন্ট পার্সনের নাম পাবলিশ করা।
১৮. ওয়ার্ক পারমিট/ভিসা ও সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স ব্যবস্থার উন্নতি।
অন ট্র্যাক:
১৯. বিডায় গুরুত্বপূর্ণ ইনভেস্টরদের জন্য রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট টিম চালু করা - একই সাথে দুই বছরের একটি প্রোগ্রাম ডিসাইন করে প্রাইভেট সেক্টরের দক্ষ অফিসারদের দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দেয়া।
২০. সরকারের সবগুলো ব্যবসায়ী সেবার জন্য করা ওয়ান স্টপ সার্ভিস ও ডিজিটাল প্লাটফর্মকে একীভূত করা বা একটি সিঙ্গেল সাইন ইন প্লাটফর্ম এ নিয়ে আসা।
২১. বিভিন্ন লাইসেন্সিং এর প্রয়োজনীয়তা চ্যালেঞ্জ করে লাইসেন্স এর সংখ্যা কমিয়ে আনা।
২২. সরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাইভেটাইজ করা।
২৩. মার্জার ও একুইজিশন রুল সংস্কার।
২৪. বিডা-বেজার আইন আধুনিকীকরণ।
২৫. বিডা, বেজা, বেপজা, হাই টেক পার্ক ও পিপিপি অথরিটিতে সমন্বয়হীনতা কমাতে তাদের একই ছাতার নিচে নিয়ে আসা।

পিছিয়ে আছি 
২৬. প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইসারি কাউন্সিল চালু করা: সরকারকে একদম আনফিল্টার্ড ফিডব্যাক দেবার জন্য।   
২৭. ট্যাক্স রুলস: ইনকিউবেশন, গ্রান্ডফাদারিং, সানসেট রুলস। 
২৮. ক্যাপিটাল রিপেট্রিয়েশন নীতি ও প্রক্রিয়া সংস্কার। 
২৯. বিডার সাংগঠনিক কাঠামো সংস্কার/আধুনিকায়ন। 
৩০. এনার্জি সিকিউরিটি বা জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ স্ট্রাটেজি।
অনেকগুলো উদ্যোগ আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, ইউএনডিপি, বিভিন্ন এম্বেসী আর প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করছি। অনেকেই বিনা পারিশ্রমিকে দেশসেবা / সাহায্য করছেন। তাদের ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হতো না আগানো। সংস্কারের কাজ আদৌ হচ্ছে কিনা, তাদেরকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন।    

#খ 
দেশের এক্সিস্টিং বিনিয়োগকারীদের সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করা এবং তাদের হয়ে পলিসি এডভোকেসি করা জরুরি। নতুনরা এসে তাদের কাছেই জানতে চাইবেন এদেশে ব্যবসা করা উচিত কিনা। 
- বেশ কিছু কোম্পানির ইস্যু সমাধান করা হয়েছে। যেমন: ইয়ংওয়ান গ্রূপ, মেটলাইফ, শেভ্রন, লাফার্জ, বাংলাদেশ অটোমোবাইলস। তারা পাবলিকলি এগুলা শেয়ার করেছেন। আরও অনেকে বাকি আছেন। তারা ডিসার্ভ করেন। কিন্তু লোকসল্পতার কারণে সবাইকে সাহায্য করতে পারছি না।
- পলিসি এডভোকেসির ক্ষেত্রেও কাজ হচ্ছে। যেমন: ফুল ও পার্শিয়াল বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স পলিসি সংস্কার, ম্যান মেড ফাইবার আনুষাঙ্গিক ইম্পোর্ট ডিউটি হ্রাস, ইন্সেটিভ এর জন্য নো ডেডাক্শন সার্টিফিকেট ইস্যু প্রক্রিয়া বদল, ইত্যাদি। কিছু রিফ্লেকশন এই বাজেট এ  এসেছে। আরো অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। লম্বা লিস্ট। সামনে আশা করি আরো দেখতে পাবেন। 

#গ
আমরা আগে কখনও ইনভেস্টর পাইপলাইন ট্র্যাক করতাম না। ইনভেস্টর আমাদের দেশে এমনিতেই আসবে, এই আরোগ্যান্স এর কোনো কারণ নাই। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট মেনুর অনেকগুলা অপসন এর মধ্যে একটা। তাছাড়া বিদেশে বসে গুগল সার্চ করলে আমাদের নিয়ে যে পারসেপশন তৈরি হয়, সেটা রিয়েলিটির চেয়ে অনেক বেশি নেগেটিভ। সামনের দিগুলিতে এমন চাতক পাখির মতো যাতে বসে থাকতে না হয়, ইনভেস্টররা যাতে জানেন কেন বাংলাদেশ ২.০ আগের চেয়ে আলাদা, দেশি-বিদেশী ব্যবসায়ীদের যাতে ম্যাচমেকিং হয়, সেজন্য আমরা দুটি সামিটের আয়োজন করেছি; একটি সবার জন্য, আরেকটি চীনকে ফোকাস করে। ৬৭৫ জন বিনিয়োগকারী এসেছেন এই প্রোগ্রামগুলোতে। দ্বিপাক্ষিক মিটিং হয়েছে বাংলাদেশী এবং বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনশোর একটু বেশি।
 
আমরা আগেও বলেছি, বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট একদিনে আসে না। সামিটে এসে ইমোশনাল হয়ে কেউ হুট করে ১০০ কোটি টাকার চেক লিখে ফেলে না। যারা এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজে করেন তারা জানেন। তারপরও সৌভাগ্যক্রমে তিনটি একদম নতুন বিনিয়োগ অলরেডি কনফার্ম করেছে। একটি গার্মেন্টস, একটি এয়ারলাইন্স এর এমেনিটি কিট ও একটি ঘড়ি ম্যানুফ্যাকচারার। সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। দশ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে ফ্যাক্টোরিগুলা চালু হলে। আরো প্রায় ১৫ টি প্রজেক্ট আছে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ফাইনাল হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা একটা সলিড পাইপলাইন তৈরী হলো। আগামীতে যারা বিডা চালাবেন তাদের শূন্য থেকে শুরু করতে হবে না।
 
ইনভেস্টমেন্ট সামিট নিয়ে একটা হাইপ তৈরি হয়েছিল। সেটা আমাদের টার্গেট ছিল না। আমি আগেও অনেকবার বলেছি, যে আমরা খালি একটা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড প্রোগ্রাম ডেলিভার করতে চেয়েছিলাম। এটার জন্য আলাদা কোনো বাহবা পাবার আশা আমরা একদম করি না। আরো ভালো করার অনেক সুযোগ আছে। কাজগুলো কমিটেড সময়ের মধ্যে হচ্ছে কিনা, এর জন্য আমাদের অ্যাকাউন্টেবল করুন। ধন্যবাদ।

পুনশ্চ ১:অক্টোবর থেকে এপ্রিল এর বিনোয়োগের পরিমান আর গত বছরের একই সময়ের নাম্বারটা প্রায় একই। কিন্তু এতে বিডার কোনো ক্রেডিট বা ফেইলিওর নাই। এতো বড়ো অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পরে এতো তাড়াতাড়ি বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ আগের জায়গায় ফিরে গেছে তা আশার কথা।  কিন্ত এর পেছনে মূল শক্তি অর্থনৈতিক টার্ন অ্যারাউন্ড: রিসার্ভ বৃদ্ধি, এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতি, ইত্যাদি।

পুনশ্চ ২: ইনফর্মেশন প্লিজ ভেরিফায়েড সোর্স থেকে নিবেন। ভুল তথ্যের শিকার হবেন না। আমাদের জিজ্ঞেস করুন। আমরা উত্তর দেবার চেষ্টা করবো।