
মহার্ঘ ভাতা নয়, বিশেষ প্রণোদনাই পাচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। সোমবার (২ জুন) জাতীয় বাজেট উপস্থাপনকালে এমন তথ্য জানান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
ঘোষণা অনুসারে, ১ জুলাই থেকে বেতন গ্রেডভেদে গ্রেড-১ ও তদূর্ধ্ব থেকে গ্রেড-৯ পর্যন্ত ১০ শতাংশ এবং গ্রেড-১০ থেকে গ্রেড-২০ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ হারে ‘বিশেষ সুবিধা’ দেওয়া হবে।
জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত সরকারি, বেসামরিক, স্বশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো, ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও পুলিশবাহিনীতে নিয়োজিত কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের (পুনঃস্থাপনকৃত) জন্য এ বিশেষ সুবিধা কার্যকর হবে।‘বিশেষ সুবিধার’ ঘোষণা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
‘সরকার কর বাড়ালেও আমাদের বেতন তো সেভাবে বাড়ে না’, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক মিঠুন শিকদার।
তিনি বলেন, ‘কারো বেতন বৃদ্ধি সমস্যা না, সরকার আমাদের দিকটাও একটু দেখুক।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির খবরে কালকেই তো বাজারে জিনিসের দাম বাড়বে।’
বাজেট ঘোষণার একদিনের মাথায় সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধার প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে সরকার।
সেই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তারা ১০ শতাংশ এবং পরের গ্রেডের কর্মচারীরা ১৫ শতাংশ আর্থিক সুবিধা পাবেন।
এই ‘বিশেষ সুবিধার’ বা বেতন বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যেও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, এভাবে বেতন বৃদ্ধির চেয়ে মহার্ঘ ভাতা কার্যকর হলেই বরং লাভবান হতেন তারা।
তিনি বলেন, ‘বেতন বৃদ্ধি খুশির খবর। কিন্তু এর পাশাপাশি যে হারে কর বাড়ানো হয়েছে তাতে লাভ হবে না কিছুই। কারণ মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি।’
একদিকে আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাব, অন্যদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’ দেওয়ার ঘোষণায় অবাক, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অনেকে।
তারা বলছেন, বৈষম্য দূর করার কথা বললেও আওয়ামী লীগের দেখানো পুরনো পথেই হাটছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ এতে চাপে পড়বে, আয় কর রিটার্ন সাবমিট করা ওই ৪০ শতাংশ মানুষই।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, করের হার না বাড়িয়ে কেবল আওতা বৃদ্ধি করেই রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু সেই কঠিন পথে না গিয়ে, অতীতের মতো সহজ পথই বেছে নিয়েছে বর্তমান সরকার।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ এবং দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান অনিশ্চয়তা দূর না করে, সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ সুবিধার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক ও সাংঘর্ষিক বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়িরা।
তারা বলছেন, এর ফলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়াবে।
বাজেটে রাজস্ব আয় ও করের যে প্রস্তাব
ক্ষমতা গ্রহণের দশ মাসের মাথায় গত দোসরা জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে, ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমেই ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে সরকার। অন্যান্য উৎস থেকে বাকি টাকা সংগ্রহের পর ঘাটতি থাকবে ২ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি।
এবার বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি। গত বছরের মতোই ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা রাখা হয়েছে।
তবে ২০২৬-২৭ অর্থবছর এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে এ প্রস্তাবে সার্বিকভাবে অধিকাংশ করদাতার ওপর করের চাপ বাড়িয়েছে সরকার।
এক্ষেত্রে করহারের ধাপে কিছুটা পরিবর্তন এনে সাতটির জায়গায় ছয় ধাপে করহার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
সর্বোচ্চ করহার আগের মতো ৩০ শতাংশ রাখা হলেও আগের ধাপগুলোর সীমা কমিয়ে আনায় গত বছরের সমান আয় করেও বেশি হারে কর দিতে হবে অনেক করদাতাকে।
সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’
উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৫ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই প্রণোদনাই আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এবারের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘২০১৫ সালের পর অদ্যাবধি কোনো বেতন কাঠামো প্রণিত না হওয়ায়, বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারিদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।’
জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ প্রণোদনার হার বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এরই মধ্যে (মঙ্গলবার) প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে সরকার।
যেখানে দশম থেকে বিশতম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই ৫ শতাংশসহ মোট ১৫ শতাংশ এবং নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তারা মোট ১০ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা পাবেন।
বাজেট ডকুমেন্ট অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় বরাদ্দ করা হয়েছে মোট ৮৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেম (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, ‘বিশেষ সুবিধা এই টার্মটাতেই আমার আপত্তি আছে।’
রায়হান বলেন, ‘আমরা যখন বৈষম্যবিরোধী কথা বলছি, বৈষম্য কমানোর কথা বলছি, তখন কেনো আমরা শুরুমাত্র সরকারি কর্মচারিদের জন্য একটা বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এরকম কনটেক্সটে বিষয়টি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ বিদ্যমান। তাই বিশেষ পক্ষকে সুবিধা দিলে পরিস্থিতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
এছাড়া ৯০ ভাগের বেশি মানুষ যারা সরকারি চাকরির বাইরে আছে, তাদের জন্য কোনো ধরনের বিশেষ সুবিধা রইল, এই প্রশ্নও করেন রায়হান।
সরকারি কর্মচারিদের ‘বিশেষ সুবিধা’ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা নিয়েই অবাক হয়েছেন তিনি।