Image description

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এই অবস্থায় চূড়ান্ত বাজেটে তা বাদ দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বলছি না যে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে খুব ভালো কিছু করেছি। সমাজে যদি এটা নিয়ে আপত্তি থাকে, আমরা অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’

রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল মঙ্গলবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা। আগের দিন সোমবার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা দাবি করেন, তাঁর দেওয়া বাজেট বিপ্লবী না হলেও শতভাগ বাস্তবায়নযোগ্য। মূল্যস্ফীতি কমাতে নেওয়া উদ্যোগে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, বৈষম্য হ্রাসে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো হয়েছে। করারোপে সবাইকে খুশি রাখা সম্ভব নয়, তবে সরকার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানান তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘এক বাজেটে সব করা সম্ভব নয়, যতটা পারি করব; বাকিটা নতুন সরকারের জন্য পদচিহ্ন রেখে যাব।’

৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার উচ্চ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া বাজেটে বাড়তি করারোপ ও করছাড় হ্রাসের মতো সাহসী পদক্ষেপ নেন অর্থ উপদেষ্টা। বাজেট ঘোষণার পরপরই এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এসব প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাজেটের পক্ষে সরকারের ব্যাখ্যা দিতে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থ উপদেষ্টা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান; কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী; বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন; বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা।

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় আসিনি, দায়িত্ব নিয়েছি; তা-ও দেশের এক ক্রান্তিকালে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে বলেছিলেন দেশ যেন আইসিইউতে ছিল, অর্থনীতি খাদের কিনারে পৌঁছেছিল, বিশেষ করে আর্থিক ব্যবস্থাপনায়। সেই অবস্থায় আমরা দায়িত্ব না নিলে কী হতো, বলা কঠিন। তবে সবাই মিলে এখন অন্তত একটি স্থিতিশীল অবস্থানে আনতে পেরেছি।’

সম্পদ সীমিত, চাহিদা বিপুল। বৈশ্বিক চাপ, ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের দুর্বলতা, আইনশৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জ—সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খল প্রেক্ষাপটে কাজ করতে হচ্ছে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এই বাস্তবতায় আমরা কিছু সংস্কার শুরু করেছি। যতটা সম্ভব বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’

সাংবাদিকদের উদ্দেশে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এত দিন প্রবৃদ্ধির নানা বয়ান শুনেছেন, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির সুফল কে পেয়েছে? এবার আমরা চেয়েছি মানুষের জীবনমান, ক্রয়ক্ষমতা এবং ব্যবসার গতিশীলতা—এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট সাজাতে।’

জনগণের চাহিদা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ এবং এনবিআর সংস্কার চলছে। এ কথা জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে করছি, এটি একটি জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট। কেউ কেউ বলেছেন, আমরা আগের ধারা অনুসরণ করেছি; কিন্তু হঠাৎ করে বিপ্লবী কোনো বাজেট দিয়ে বড় রাজস্ব এনে ফেলা সম্ভব নয়। তাই কিছু পুরোনো পথ অনুসরণ করেই এগোচ্ছি।’

কালোটাকা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত

প্রশ্নোত্তর পর্বে অর্থ উপদেষ্টার কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান—যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ও স্বচ্ছ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রাখা সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? এর জবাবে সালেহউদ্দিন আহমেদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এটা আসলে কালোটাকা নয়, বরং অপ্রদর্শিত অর্থ। কোনো কারণে কারও যদি এমন অর্থ থেকে থাকে, সেটিকে বৈধ করতে ৫ গুণ জরিমানা দিয়ে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।’

তবে এই ব্যবস্থায় আপত্তি থাকলে চূড়ান্ত বাজেটে তা বাদ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনা হবে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা বলছি না যে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে খুব ভালো কিছু করেছি। সমাজে যদি এটা নিয়ে আপত্তি থাকে, আমরা অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখলেও তা সীমিত পরিসরে এবং কঠোর শর্তে দেওয়া হয়েছে। ফ্ল্যাট বা জমি কেনার ক্ষেত্রে নির্ধারিত হারে অতিরিক্ত কর দিলে এনবিআর তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। তবে অন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো চাইলে ওই আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে।

দাম বাড়ার বাস্তবতা এবং বাজেট-বাজার সম্পর্ক

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘বাজেট ঘোষণার পর সবকিছুর দাম কমে যাবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। বিশ্বের যেকোনো দেশেই বাজেটের পরে পণ্যের দাম বাড়ে বা কমে। তবে আমি বলছি না, দাম বাড়া ভালো।’

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বহুমুখী উদ্যোগ

ফাওজুল কবির খান জানান, মূল্যস্ফীতি কমাতে জ্বালানির দাম কমানো হয়েছে। এলপিজির দাম কমেছে, জ্বালানি তেলের দামেও ছাড় দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সড়ক পরিবহনে চাঁদাবাজি রোধেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আজকেই (গতকাল) একটি বাস কোম্পানি ঈদের বাড়ি ফেরা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছিল। আমরা তাৎক্ষণিক মোবাইল কোর্ট পাঠিয়ে জরিমানা করেছি।’

কৃষি উপদেষ্টা জানান, সবজির অফ সিজনে সরবরাহ ঠিক রাখতে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ১০০টি কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ করছে। এতে শীত ও গ্রীষ্মের মাঝামাঝি আলু, পেঁয়াজসহ মৌসুমি সবজির দাম স্থিতিশীল থাকবে।

তবে কৃষকের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভোক্তার স্বার্থ নিয়ে যতটা কথা বলা হয়, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিয়ে ততটা বলা হয় না। তবু সামগ্রিকভাবে ঈদ ও রোজার বাজার বিশ্লেষণ করলে তিনি বর্তমান বাজার পরিস্থিতিকে ‘স্বস্তিদায়ক’ বলে অভিহিত করেন।

বাজেটের দুর্বল দিক নিয়ে খোলামেলা স্বীকারোক্তি

এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘সম্পদ যদি আরও বেশি পেতাম, কর-ভ্যাট ফাঁকি না থাকত, রাজস্ব আদায় বাড়ানো যেত, দুর্নীতি না হতো, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে পারতাম; তাহলে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের কাছে বাজেট সাপোর্ট চাইতে হতো না। সেই অর্থ দিয়েই বাজেট বাস্তবায়ন করা যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা সেটি পারিনি। যাঁরা টাকা পাচার করেন, তাঁরা খুবই চতুর। তাঁদের অর্থ ফেরত আনা সহজ কাজ নয়।’

তবে অর্থ উপদেষ্টা জানান, দ্রুত অর্থ ফিরিয়ে আনতে ইতিমধ্যে ১২টি মামলা করা হয়েছে এবং প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এসব মামলার মাধ্যমে অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

আমানতের নিরাপত্তা ও ব্যাংক খাতের বাস্তবতা

ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ও বেশি মাত্রার ঋণ গ্রহণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আশ্বস্ত করেন, আমানতকারীদের অর্থ কখনোই খেয়ানত হবে না। তবে তিনি একই সঙ্গে ব্যাংক খাতের গভীর অসংগতির চিত্রও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এমন নজির নেই, যেখানে ডাকাতি করে গ্রাহকের টাকার ৭০ শতাংশ আত্মসাৎ করে মালিকেরা বিদেশে পালিয়ে গেছেন। ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১৫ হাজার কোটিই বের করে নেওয়া হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকে বের করে আনা হয়েছে। আমরা স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছি।’