
দুলাল হোসেন ওরফে সেলিম জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লেগে গত বছরের ৩ আগস্ট তিনি মারা যান। আদালতে এমন বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনাসহ ৪১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন সেলিমের বড় ভাই মোস্তফা কামাল। তবে পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, সেলিম এখনো জীবিত। এরপর সেলিম নিজেকে জীবিত থাকার প্রমাণ দিতে থানা-আদালতে ঘুরছেন।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার কুশমাইল ইউনিয়নের ধামর বেলতলী বাজার এলাকায় বাড়ি সেলিমের। জীবিত ভাইকে জুলাই আন্দোলনে ‘মৃত’ দেখানো মামলার বাদী মোস্তফা কামাল থাকেন ঢাকায়। এলাকায় তিনি ‘মোস্ত ডাকাত’ নামে পরিচিত। এ নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
২০২৪ সালের ৩০ আগস্ট আদালতের আদেশে যাত্রাবাড়ী থানায় সেলিম হত্যা মামলা রেকর্ড হয়। তার আগে ২৭ আগস্ট তাকে নিজের ভাই উল্লেখ করে রাজধানীর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন মোস্তফা কামাল। আরজিতে ৩ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার শনির আখড়ার কাজলা পেট্রলপাম্পের সামনে ছাত্র-জনতার মিছিলে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেলিম মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়।
সেলিমের (৪৮) বাবার মৃত আবদুল হাকিম। তিনি ছোট ছেলে। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর নাম মো. সেলিম থাকলেও মামলায় তাঁকে দুলাল হোসেন ওরফে সেলিম দেখানো হয়েছে। তাঁর বড় তিন ভাই হলেন হেলাল উদ্দিন, আবুল হোসেন ও মামলার বাদী মোস্তফা কামাল। মোস্তফা কামাল এলাকায় ‘মোস্তু ডাকাত’ নামে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় হত্যা, চাঁদাবাজি ও মারামারির মামলা রয়েছে। দুটি হত্যাকাণ্ডের পর ১৫ বছর ধরে তিনি এলাকাছাড়া।
২০২৪ সালের ৩০ আগস্ট আদালতের আদেশে যাত্রাবাড়ী থানায় সেলিম হত্যা মামলা রেকর্ড হয়। তার আগে ২৭ আগস্ট তাকে নিজের ভাই উল্লেখ করে রাজধানীর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন মোস্তফা কামাল। আরজিতে ৩ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার শনির আখড়ার কাজলা পেট্রলপাম্পের সামনে ছাত্র-জনতার মিছিলে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেলিম মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়।
তার লাশ উদ্ধার করে রাজধানীর গোপীবাগ এলাকার রামকৃষ্ণ মিশনের (আর কে মিশন রোড) পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয়। মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ৪১ জনের নাম উল্লেখ এবং ১৫০ থেকে ২০০ নেতা-কর্মীকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলার বাদী মোস্তফা কামালের (৫৫) ঠিকানা হিসেবে আর কে মিশন রোড, বদী মেম্বারের বাড়ি, মুগদা, ঢাকা উল্লেখ করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফুলবাড়ীয়া থানা-পুলিশ মৃত ব্যক্তির ঠিকানা অনুযায়ী তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, সেলিম এখনো জীবিত এবং নিজ এলাকায় আছেন।
ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান বলেন, ভাইদের নিজেদের মধ্যে জমিজমা নিয়ে বিরোধ আছে। মামলার বাদী মোস্তফা ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে এলাকা ছাড়া। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় দুটি হত্যা, একটি করে চাঁদাবাজি ও মারামারির মামলা ছিল।
তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে মৃত দেখানোর পর সেলিম আতঙ্কে থাকায় তাঁকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাড়ির আশপাশে বাতি জ্বালিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।
‘মৃত’ দেখিয়ে বড় ভাই মামলা করায় সেলিম এখন নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে থানা ও আদালতে দৌড়াচ্ছেন। সেলিমের কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় ১৫ বছর আগে স্ত্রী হাজেরা খাতুন এবং দুই মেয়েকে নিজের কেনা সম্পত্তি থেকে ৪৯ শতক জমি লিখে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে বড় ভাই হেলাল উদ্দিন ও আবুল হোসেনে সঙ্গে বিরোধ চলছিল। ভাইদের সঙ্গে বিরোধের জেরে ২০২২ সালের ১৮ মে সেলিমকে গুরুতর জখম করা হয়।
সে ঘটনায় ২৪ মে সেলিম থানায় মামলা করেন। ভাইদের অত্যাচারে বছরখানেক আগে বাড়ি ছেড়ে ধামর বেলতলী বাজারে আড়াই শতক জমি কিনে ঘর করে বসবাস করছেন বলে জানিয়েছেন। সেখানে তাঁর একটি মুদি দোকান আছে।
সেলিম বলেন, ‘আন্দোলনে ৩ আগস্ট আমি মারা গেছি দেখিয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় আমার ভাই মোস্তফা কামাল মামলা করেছেন। একটি ইস্যু সৃষ্টি করে আমাকে পরিকল্পনা করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমি সরকারি লাশ হয়ে যেতাম। আমার স্ত্রী-সন্তান বিচারের জন্য থানায় গেলে তারা দেখত, ৩ আগস্ট আমি মারা গেছি। আন্দোলনের আগে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। তখন বাড়িতে থাকলে তারা আমাকে মেরে ফেলত।’
সেলিম বলেন, তার ভাইয়েরা প্রায় ১৫০ শতক জমি দখল করে রেখেছেন। এ নিয়েই ভাইদের সঙ্গে বিরোধ। আদালতে মামলাও চলছে। তার ভাইয়েরা বাড়িতে গেলে মেরে ফেলার ভয় দেখান। এ জন্য ভয়ে বাড়িতে যান না। ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেন না। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি জীবিত সেটি প্রমাণ করতে দুবার আদালতে গেছি; পুলিশের কাছে গেছি কয়েকবার।’ নিজের ভাইদের বিচার চান তিনি।
মোস্তফা কামালের ভিটেবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণ বাড়িতে কেউ বসবাস করেন না। তার স্ত্রী হাজেরা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীরে ছাত্র আন্দোলনে মৃত দেখাইয়া ভাশুরে মামলা করছে। কিন্তু আমার স্বামী তো দোকান করে। বাড়িতে থাকলে মাইরা ফেলত, আর দেখাইত আন্দোলনে মারা গেছে। বাড়ি ছেড়ে দেওয়ায় আর মারতে পারেনি। এখন আমরা সব সময় ভয়ে থাকি।’
সেলিম হত্যা মামলাটি এখন তদন্ত করছেন গোয়েন্দা পুলিশের ঢাকা ওয়ারীর উপপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম। তিনি তৃতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা। আমিনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাদীকে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলায় যাকে মৃত দেখানো হয়েছে, তিনি সম্ভবত বাদীর ভাই। জীবিত ব্যক্তি বাদীর ভাই কি না যাচাইয়ের জন্য আদালতে ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করলে আদালত অনুমতি দিয়েছেন। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পেলে সেলিম বাদীর ভাই কি না নিশ্চিত বলা যাবে।
তিনি বলেন, ‘বাদীকে পাওয়া না গেলেও মামলা করায় ঘটনার সত্যতা যাচাই করার দায়িত্ব আমাদের। আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি।’
ফুলবাড়ীয়া থানার ওসি রুকনুজ্জামান বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে ‘নিহত’ সেলিম আমার কাছে এসেছিল। তাকে সাবধানে থাকার জন্য বলা হয়েছে। মামলার বাদী গোলাম মোস্তফা এলাকায় মোস্ত ডাকাত নামে পরিচিত। তার নামে দুটি হত্যা মামলা, চাঁদাবাজি ও একটি মারামারি মামলা রয়েছে। মামলার পর থেকে তিনি পলাতক। ঢাকায় থাকেন বলে শুনেছি। পেশায় তিনি এখন ঢাকা শহরের বাসচালক।’
মামলার পর থেকে বাদীসহ সেলিমের অপর ভাই ও পরিবারের সদস্যরা গাঁ ঢাকা দিয়েছেন। ফলে মোবাইল ফোনে এবং বাড়িতে গিয়েও তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।